বিবিধ

বাড়িভাড়া নিয়ে ঝামেলা হলে কী করবেন

Published

on

ঘটনা-১
বেশ কয়েক বছর আগে উত্তরায় একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন এক চাকরিজীবী দম্পতি। অফিস মতিঝিলে হওয়ায় ফ্ল্যাট কেনার পরও সেখানে নিজেরা থাকেননি। ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়ে দেন। দুই বছর পর মেট্রোরেল চালু হবে ভেবে নিজেদের ফ্ল্যাটে ওঠার সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। কিন্তু বেঁকে বসেন ভাড়াটে। ভাড়াটে ফ্ল্যাট ছাড়তে রাজি নন। যদিও তাঁদের মধ্যে দুই বছরের চুক্তি ছিল, যা ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এখন নাছোড়বান্দা ভাড়াটে কোনোভাবেই বাসা খালি করে দিচ্ছেন না, ভাড়াও পরিশোধ করেন না ঠিকমতো। কী করবেন এই দম্পতি এখন? নিজের ফ্ল্যাটে নিজেরা উঠতে পারবেন কবে, এ চিন্তায় দিশাহারা তাঁরা।

ঘটনা-২
দেড় বছর ধরে ভাড়াবাড়িতে থাকছেন মানিক (ছদ্মনাম) ও তাঁর স্ত্রী মুনা (ছদ্মনাম)। যদিও চুক্তিতে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই, যখন-তখন বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছেন। বছরের শুরুতে তিন হাজার টাকা বাসাবাড়া বাড়িয়ে দেওয়ার কথা মৌখিকভাবে জানিয়েছেন তিনি। ছেলে কাছের স্কুলে পড়ে বলে বাসাও ছাড়তে পারছেন না মানিক ও তাঁর স্ত্রী। এদিকে ভাড়া রসিদও দেন না বাড়িওয়ালা। এখন নতুন বছরে কী করবেন মানিক?

বাড়িভাড়া নিয়ে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। কিন্তু বাড়িভাড়া নিয়ে এ ধরনের বাড়াবাড়ির সমাধান কী?

বাড়িওয়ালার আইনি প্রতিকার
ওপরের প্রথম ঘটনার দম্পতির মতো যদি ভাড়াটের কাছে হেনস্তার শিকার হন কিংবা ভাড়াটে বাসা ছাড়তে রাজি না হন, তাহলে ভাড়াটেকে কি উচ্ছেদ করা যায়। সাধারণত আইন অনুযায়ী যেসব কারণে ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা যায়:

১. ভাড়াটে যদি ভাড়ার চুক্তির শর্তাবলি লঙ্ঘন করে সাবলেট বা উপভাড়া দেন।

Advertisement

২. ভাড়াটের আচরণ যদি উৎপাতের পর্যায়ে পড়ে এবং প্রতিবেশীদের জন্য উৎপাত বা বিরক্তির কারণ হয়।

৩. বাড়িওয়ালার অনুমতি ছাড়া বাড়ির নকশা পরিবর্তন করলে।

৪. ভাড়াটে যদি বাসাটি অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন।

৫. বাড়িটি মেরামত কিংবা বাড়িওয়ালার বসবাসের জন্য যদি সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন হয়।

৬. সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৮ ধারায় বর্ণিত কিছু কারণে

Advertisement

সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৬ ধারা অনুযায়ী ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা যাবে। বাসাবাড়ি, দোকানঘর, অফিস, গুদাম প্রভৃতি যদি মাসিক ভাড়ায় ব্যবহার করা হয়, সে ক্ষেত্রে ১৫ দিনের নোটিশে ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা যায়। চুক্তি যদি বার্ষিক ইজারা হয় বা শিল্পকারখানা হয়, সে ক্ষেত্রে ছয় মাসের নোটিশে উচ্ছেদ করা যায়। যদি নোটিশ পাওয়ার পরও ভাড়াটে বাসা না ছাড়েন, তাহলে উচ্ছেদের মামলা করতে হয় দেওয়ানি আদালতে।

ভাড়াটের আইনি প্রতিকার
আপনি যদি ওপরের মানিকের মতো ভাড়াটে হন, তাহলে আপনার প্রতিকারের ব্যবস্থা আইনে রয়েছে। বাড়িওয়ালা ইচ্ছা করলেই যখন-তখন বাড়ির ভাড়া বাড়িয়ে দিতে পারেন না। আর যদি বাড়িয়ে দেন, তাহলে আপনি বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ অনুযায়ী প্রতিকার চাইতে পারেন। আইনে বলা হয়েছে, প্রতি দুই বছর পর বাড়িওয়ালা বাড়িভাড়া বাড়াতে পারবেন, তবে তা হবে যুক্তিসংগত। অর্থাৎ বাড়িওয়ালা একবার ভাড়া বাড়ালে দুই বছরের আগে ভাড়া আর বাড়াতে পারবেন না।

অনেক সময় ভাড়া খেলাপি হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আপনার দেওয়া ভাড়া বাড়িওয়ালা গ্রহণ না-ও করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আইনে আপনার প্রতিকারের পথ খোলা আছে। আপনি বাড়িভাড়ার টাকা আদালতে জমা দেওয়ার মাধ্যমে ভাড়া খেলাপির দায় থেকে বাঁচতে পারেন। আইন অনুযায়ী বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ এবং সমস্যা সমাধানের জন্য ভাড়া নিয়ন্ত্রক রয়েছেন। সাধারণত সিনিয়র সহকারী জজ আদালতগুলো ভাড়া নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ নিয়ন্ত্রক কোনো অভিযোগের ভিত্তিতে দরখাস্তের শুনানি করতে পারবেন। প্রয়োজনে বাড়ির মালিক ও ভাড়াটের প্রতি নোটিশ জারি করতে এবং কোনো বাড়িতে প্রবেশ ও পরিদর্শনের ক্ষমতা আছে নিয়ন্ত্রকের।

বাড়িওয়ালা কোনো কারণে ভাড়া গ্রহণে অস্বীকৃতি জানালে ভাড়াটেকে চুক্তি অনুযায়ী সময়ের মধ্যে অথবা চুক্তি না থাকলে পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে মনি অর্ডারযোগে বাড়িওয়ালার ঠিকানায় ভাড়া প্রেরণ করতে হবে। মনি অর্ডারযোগে প্রেরিত ভাড়ার টাকাও যদি বাড়িওয়ালা গ্রহণ না করেন, তাহলে ওই টাকা ফেরত আসার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে ভাড়াটেকে ভাড়া নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ সিনিয়র সহকারী জজ বরাবর দরখাস্ত দিতে হবে এবং ভাড়া জমা দিতে হবে। এ জন্য একজন আইনজীবীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক বরাবর আবেদন করতে হবে। ভাড়া নিয়ন্ত্রক প্রাথমিকভাবে শুনানির পর যদি সন্তুষ্ট হন যে ভাড়া প্রদানের জন্য অনুমতি দেওয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে ভাড়ার টাকা আদালতে জমা দেওয়া যাবে এবং তা প্রতি মাসে আদালতে জমা দেওয়া যাবে। বাড়িওয়ালা আদালত থেকে এ ভাড়ার টাকা উত্তোলনের সুযোগ পাবেন।

বাড়িভাড়ার ক্ষেত্রে করণীয়
বাড়িভাড়া নেওয়ার সময় বাড়িওয়ালার সঙ্গে লিখিত চুক্তি করা উচিত। চুক্তিতে কী কী শর্তে ভাড়া দেওয়া হলো এবং করণীয় বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। ভাড়া কখন বাড়ানো যাবে এবং তা কেমন হারে হবে,অগ্রিম কত জমা দেওয়া হবে, কখন বাড়িওয়ালা ভাড়াটেকে বাড়ি ছাড়তে বলতে পারেন, ভাড়াটে কখন বাড়ি ছাড়বেন এবং ভাড়ার মেয়াদ সুনির্দিষ্ট করে বলা থাকতে হবে চুক্তিতে। অবশ্যই প্রতি মাসে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ভাড়ার লিখিত রসিদ সংগ্রহ করে রাখতে হবে।

Advertisement

তানজিম আল ইসলাম সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

সর্বাধিক পঠিত

Exit mobile version