দেশের সরকারের পরিচালন ব্যয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ সামাজিক অবকাঠামো খাত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং উন্নয়ন ও সমবায় এ খাতের আওতাভুক্ত। এ খাত বাদ দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কঠিন। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এ খাতে বরাদ্দ ও অবদান দুটোই কমছে, যা অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখকর নয়। টেকসই সামগ্রিক উন্নয়ন নিশ্চিতে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হলে সরকারকে কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, ঋণের সুদ পরিশোধ, ভর্তুকি ও প্রণোদনা খাতে সরকারের ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। ব্যয় অনুপাতে আয় বাড়ছে না। সরকার কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আহরণ করতে না পারায় এসব পরিচালন ব্যয় মেটাতে গিয়ে সামাজিক অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ কমাতে হচ্ছে। এছাড়া উন্নয়ন ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ছে সরকারের জন্য। এ ব্যয় মেটানোর জন্য স্থানীয় ও বিদেশী উৎস থেকে ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যা আবার সুদ ব্যয়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সরকারের এসব বাড়তি ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে সংকুচিত হচ্ছে সামাজিক অবকাঠামো খাতের বরাদ্দ। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হলে পরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। রাজস্ব আহরণ বাড়ানো না গেলে দেশীয় ও বিদেশী ঋণের পরিমাণ বাড়বে, যা অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।
বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ সামর্থ্যের অর্ধেকেরও কম। রাজস্ব আহরণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আহরণ করতে না পারায় অবকাঠামো উন্নয়ন, মানবপুঁজি গঠন, সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয় কিংবা অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়নে পর্যাপ্ত অর্থের জোগান অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।
তবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার এ পর্যায়ে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন ব্যয় তা খুব বেশি নয়। মূলত অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণেই সামাজিক অবকাঠামো খাতসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কমছে।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আহরণ হতাশাজনক। কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে।
জিডিপির অনুপাতে করের অংশ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। এ নিয়ে নীতিনির্ধারকরা আশাবাদী হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। গত এক দশকে কর-জিডিপি অনুপাত না বেড়ে বরং কমেছে। ২০২৩ সালে জিডিপির অনুপাতে করের অংশ দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এক দশক আগে ২০১২ সালে যা ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিভিন্ন অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি সরকার। রাজস্ব আহরণে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূরীকরণেও উদ্যোগ নিয়ে সরকারকে রাজস্ব আহরণে যথাযথ নীতি অনুসরণ করা দরকার।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট প্রতিবেদনে প্রত্যাশিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ কেন বাড়ানো যাচ্ছে না, সে বিষয়ে বেশকিছু কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। কারণগুলো হলো: অর্থ পাচার, কর ফাঁকি, অবৈধ পুঁজিপ্রবাহ, সনাতনী পদ্ধতির কর আহরণ পদ্ধতি, কর কর্মকর্তাদের প্রতি করদাতাদের আস্থার সংকট, করছাড় নীতি, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি।
তবে অনেক দিন ধরেই দেশী-বিদেশী অর্থনীতি বিশ্লেষকরা এসব বিষয়ে কথা বলছেন। সরকারি পর্যায়ের কিছু সুপারিশও বছরের পর বছর ঝুলছে। এক্ষেত্রে তেমন কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কাম্য।
রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কর্তৃপক্ষকে করদাতা ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থার ঘাটতি কমিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে। রিটার্ন দাখিলে সম্পদের তথ্য ঘোষণার ক্ষেত্রে হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সৎ করদাতাদের কর প্রদানে উৎসাহ দিতে হবে। কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। কারণ বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার কারণেও প্রকৃত করদাতারা নিরুৎসাহিত হন। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি করতে দেখা যায় না। এ ধরনের নীতি সিদ্ধান্ত প্রকৃত করদাতাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা রাজস্ব আহরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
বিদেশে অর্থ পাচার রাজস্ব আহরণে দুর্বলতার অন্যতম বড় কারণ, যা বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ট্যাক্স জাস্টিস রিপোর্ট ২০২০-এ বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার পরিমাণ জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। করপোরেট কর ফাঁকিসহ পাচারের কারণে ২০২০ সালে প্রায় ৭০ কোটি ডলার কম রাজস্ব পায় সরকার, যা ওই বছরের মোট রাজস্বের ২ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশের সমমানের অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি।
২০২১ সালের গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনার বেশির ভাগই আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং কিংবা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে হয়। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের বাণিজ্যিক ফাঁকফোকরে বছরে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে যায়।
রাজস্ব আহরণে গতি বাড়াতে করদাতাদের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে অগ্রাধিকার এবং সনাতনী পদ্ধতির জটিলতা এড়িয়ে প্রণোদনামূলক ব্যবস্থার দিকে যেতে হবে। কর কাঠামোকে পুরোপুরি অটোমেটেড করা দরকার। এ ধরনের ব্যবস্থায় কর পরিশোধ সহজ হবে এবং সেই সঙ্গে কর ফাঁকি ও কর আহরণে দুর্নীতির সুযোগও বন্ধ হবে। নিবন্ধিত করদাতারা কর না দিলে তা খুব সহজে শনাক্ত করা যাবে। কমে আসবে কর কম দেয়া কিংবা ফাঁকির সুযোগ। করের পরিমাণ নির্ধারণ এবং পরিশোধ প্রক্রিয়াও সহজ হবে। সহজ হবে একইভাবে ভ্যাট আদায় কার্যক্রমও।
দক্ষ ব্যবস্থাপনায় রাজস্ব আদায় বাড়ানো গেলে সামাজিক অবকাঠামো খাতসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়বে বলে আশা করা যায়। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির স্বাস্থ্য ভালো হবে।