এক বছর আগের তুলনায় সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের দাম ছিল কম। তাতে বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৩-২৪) আমদানি খরচ কমেছে। আমদানি খরচ কমলেও আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
কাস্টমস কর্মকর্তা ও আমদানিকারকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমলেও শুল্ক-কর আরোপের জন্য ডলারের দাম নিয়মিত বাড়ানো হয়েছে। তাতে শুল্ক-কর বাড়েনি এমন পণ্যেও রাজস্ব আদায় বেড়ে গেছে। আবার বছরের পর বছর খেজুর, বাদামের মতো কিছু পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য হালনাগাদ করেছে কাস্টমস। তাতে সেখান থেকেও রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
বিশ্ববাজারে দাম কমলেও অনেক পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য তাৎক্ষণিকভাবে কমানো হয়নি। এ ছাড়া আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিলাসপণ্য ও অপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক-কর বাড়ানোর প্রভাবও পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। তাতে সব মিলিয়ে আমদানি ব্যয় কমলেও রাজস্ব আদায় বেড়েছে।
আমদানি ব্যয় কম, রাজস্ব আদায় বেশি
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানির কাঁচামাল বাদে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য (জাহাজভাড়া, বিমাসহ পণ্যের মূল্য) ছিল ৬ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা বা ৬ হাজার ৩২৮ কোটি ডলার। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য কমে দাঁড়ায় প্রায় ৬ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা বা ৫ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার। অর্থাৎ ডলারের হিসাবে আমদানি মূল্য কমেছে ৬৮৭ কোটি ডলার বা প্রায় ১১ শতাংশ। চট্টগ্রাম, মোংলা, বেনাপোলসহ ৪০টি কাস্টম হাউস ও কাস্টম স্টেশনের তথ্যের ভিত্তিতে এই চিত্র পাওয়া গেছে।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আদায় বেড়ে হয়েছে প্রায় ৯৯ হাজার কোটি টাকা। আমদানি পর্যায়ে কাস্টমস শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও জরিমানা থেকে এই রাজস্ব আদায় হয়েছে। অর্থাৎ রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চূড়ান্ত হিসাবে রাজস্ব আদায় আরও বাড়বে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।
আমদানিকারকেরা আমদানি পণ্য খালাসের সময় রাজস্ব প্রদান করেন। এনবিআরের রাজস্ব আদায় নিয়ে জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, মোটাদাগে দুটো কারণে রাজস্ব আদায় বেড়েছে। এক. ডলারের বিনিময়মূল্য নিয়মিত বাড়ানো হয়েছে। দুই. বিশ্ববাজারে দাম কমলেও কাস্টমস শুল্কায়ন মূল্য কমায়নি। এ কারণে আমদানি ব্যয় না বাড়লেও রাজস্ব আদায় বেড়ে গেছে।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম মাস গত বছরের জুলাইয়ে শুল্ক-কর আরোপের জন্য ডলারের বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১০৮ টাকা ৮০ পয়সা। এরপর আট দফা বিনিময় মূল্য বাড়িয়ে গত ২৩ জুন ১১৭ টাকা ৯৪ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৯ টাকা। বিনিময় মূল্য বাড়ার কারণে একই ডলারে আমদানি পণ্যের মূল্য টাকায় বেড়ে যাচ্ছে। আর শতাংশ হারে শুল্ক-কর আদায়ের কারণে রাজস্ব আদায়ও বেড়েছে।
আবার কিছু পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে শুল্ক-করও ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে বাড়তি ছিল। খেজুরের উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই পণ্যের আমদানি আগের চেয়ে ছয় হাজার টন কমেছে। আমদানি কমলেও খেজুর থেকে রাজস্ব আদায় ৭০ গুণ বেড়ে ৬৬২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে খেজুরে মোট শুল্ক-কর ছিল ১০ শতাংশ। গত অর্থবছর তা বাড়িয়ে ৫৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়। শুল্ক-কর প্রায় ছয় গুণ বাড়ালেও রাজস্ব আদায় ৬০ কোটি টাকার বেশি হতো না। রাজস্ব আদায় বাড়ার মূল কারণ শুল্কায়ন মূল্য পরিবর্তন। ব্যবসায়ীরা খেজুরের সঠিক দাম ঘোষণা করছেন না এমন অভিযোগে চট্টগ্রাম কাস্টমস শুল্কায়ন মূল্য বাড়িয়ে দেয়। তাতে রাজস্ব আদায় রকেট গতিতে বেড়েছে।
এ ছাড়া আমদানি নিয়ন্ত্রণে ফলসহ অপ্রয়োজনীয় পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছিল। এতেও রাজস্ব আদায় বেড়েছে। যেমন বিদেশি ফলের উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছরে বিদেশি প্রধান পাঁচটি ফল মাল্টা, কমলা, আপেল, আঙুর ও ডালিম আমদানি ১৩ হাজার টন কমেছে। কিন্তু তারপরও রাজস্ব আয় ১ হাজার ১৩৭ কোটি টাকা বেড়ে ৪ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
এদিকে অনেক পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য কমানো হয়নি। তাতে আমদানি কমলেও রাজস্ব আয় বেড়েছে। যেমন সিমেন্টের আমদানি ১২ লাখ টন কমে দুই কোটি টনে নেমেছে। কিন্তু এ খাত থেকে রাজস্ব আদায় ৪৫৪ কোটি টাকা বেড়ে ৩ হাজার ৭২৩ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
রাজস্ব আদায়ে বিদায়ী বছরে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস। এতে আমদানিকারকেরা চাপে পড়েছেন। বিদায়ী অর্থবছরে এই কাস্টম হাউসের রাজস্ব আদায়ে সোয়া ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদায়ী অর্থবছরে চট্টগ্রাম কাস্টমস রাজস্ব আদায় করেছে ৬৮ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান বলেন, শুল্কায়ন মূল্য হালনাগাদ ও নিয়মিত তদারকির কারণে চট্টগ্রাম কাস্টমসে রাজস্ব আদায়ে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সরকারি সংস্থার কাছে আমদানি খাতে বকেয়া রাজস্ব আদায় হলে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়তে পারে।