প্রতি বছর বাজেট প্রণয়নের সময় বড় একটি অংশ বরাদ্দ রাখা হয় সামাজিক অবকাঠামো খাতে। জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নে এ খাতের আওতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং উন্নয়ন ও সমবায় বাবদ অর্থ ব্যয় করে থাকে সরকার, যা বিবেচিত হয় সরকারের পরিচালন ব্যয়ের অংশ হিসেবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও সরকারের মোট পরিচালন ব্যয়ে সামাজিক অবকাঠামো খাতের অংশ ছিল সবচেয়ে বেশি। সে সময় মোট পরিচালন বাজেটের ৩২ দশমিক ১ শতাংশ বরাদ্দ ছিল এ খাতে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা নেমে আসে ২৫ দশমিক ৯ শতাংশে। একই সময় মোট পরিচালন ব্যয়ে সামাজিক অবকাঠামোর অংশ ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২৭ দশমিক ২ শতাংশে।
যদিও এ সময়ের মধ্যে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত সাত অর্থবছরে পরিচালন ব্যয়ের আকার বেড়েছে ১০৫ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৭৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২ লাখ ৯ হাজার ২৮ কোটি ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিচালন খাতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের মধ্যে ২৯ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থ খরচ হয়েছে সামাজিক অবকাঠামো খাতে। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে এ বাবদ ব্যয় হয়েছে পরিচালন ব্যয়ের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ। আলোচ্য অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ব্যয় ছিল ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরের ৩ লাখ ৯ হাজার ৩৭২ কোটি টাকার পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে সরকার সামাজিক অবকাঠামো খাতে ব্যয় করেছে ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থ। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের মোট পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ২১ কোটি টাকা। এ সময়ে সামাজিক অবকাঠামো খাতে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে সরকার।
সরকারের খাতভিত্তিক ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ হয়েছে সামাজিক অবকাঠামো খাতে। যদিও সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে পরিচালন ব্যয়ের সবচেয়ে বেশি ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ গেছে প্রশাসন খাতে। সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এ খাতের ব্যয়ের বড় অংশ। তাছাড়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সুদ বাবদ পরিচালন ব্যয়ের ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হলেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। পাশাপাশি ঋণের পরিমাণ বাড়ার কারণে সরকারের সুদ বাবদ ব্যয়ও বাড়ছে। বাড়তি এ ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে সামাজিক অবকাঠামো খাতে ব্যয়ের অংশ কমে গেছে। যদিও এ খাতে ব্যয় আরো বাড়ার কথা ছিল। অন্যদিকে কাঙ্ক্ষিত হারে সরকার রাজস্ব আহরণ করতে পারছে না। ফলে পরিচালন ব্যয় মেটাতে গিয়ে রাজস্ব উদ্বৃত্তের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এতে উন্নয়ন ব্যয় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ছে সরকারের জন্য। এ ব্যয় মেটানোর জন্য স্থানীয় ও বিদেশী উৎস থেকে ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যা আবার সুদ ব্যয়কে বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সুসংহত করার মাধ্যমে জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ধরনের ভাতা দিচ্ছে সরকার। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছর এসব ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে জনপ্রতি টাকার অংকে এ আর্থিক সহায়তার পরিমাণ খুবই কম। এর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণীতে রয়েছে বয়স্ক, বিধবা ও নিগৃহীতা নারী এবং প্রতিবন্ধীরা। এ তিন শ্রেণীর ভাতাভোগীর সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ১২ লাখ ৭৬ হাজার। বর্তমানে ভাতাপ্রাপ্তদের মধ্যে বয়স্করা প্রতি মাসে ৬০০ টাকা, বিধবারা ৫৫০ এবং প্রতিবন্ধীরা পাচ্ছেন ৮৫০ টাকা। গত পাঁচ বছরের মধ্যে জনপ্রতি বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা ১০০ টাকা এবং নারী ভাতা ৫০ টাকা বেড়েছে। যদিও এ সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে।
সাবেক অর্থ সচিব ও সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা কিছুটা বাড়ানো হলেও ভাতার পরিমাণ সেভাবে বাড়েনি। মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করার পাশাপাশি দারিদ্র্য মোকাবেলায় ভাতার পরিমাণ না বাড়ানোর কারণে দিন শেষে যেহেতু আমাদের বাজেটের আকার বাড়ছে, সেহেতু এর সঙ্গে তুলনা করলে সামাজিক অবকাঠামো খাতে ব্যয় কমে আসাই স্বাভাবিক। কভিড ও মূল্যস্ফীতির অভিঘাত মোকাবেলায় ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। অন্যদিকে মোট ব্যয় যেটি বাড়ছে সেটি যাচ্ছে ভৌত অবকাঠামোয়। এ ব্যয়ের গুণগতমান নিয়েও প্রশ্ন আছে।’
রাজস্ব আহরণের মাধ্যমে সরকারের যে আয় হয় সেখান থেকেই পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করা হয়ে থাকে। তবে গত সাত বছরে সরকারের পরিচালন ব্যয় যে হারে বেড়েছে রাজস্ব আহরণ সে হারে বাড়েনি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকারের মোট রাজস্ব আয় ছিল ২ লাখ ৭৫২ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আয় দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকায়। এ সময়ে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে ৮২ শতাংশ। যদিও এ সময়ে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ১০৫ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির আওতায় সামাজিক ও দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের অর্থায়নের বিষয়ে জোর দেয়া হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় অনুমোদন দেয়ার পর সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের পরিমাণ এবং রাজস্ব আয় ও অনুদানের অনুপাত ৭১ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। রাজস্বের অনুপাতে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ার কারণে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে করে দারিদ্র্যবান্ধব ও সবুজ প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারে অতি প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করতে পারে। আইএমএফের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য বেশকিছু নীতিগত সুপারিশ করা হয়েছে। সংস্থাটি বলছে কর রাজস্ব বাড়ানো এবং ব্যয় যৌক্তিকীকরণ করা প্রয়োজন, যাতে সামাজিক ও বিনিয়োগ খাতে ব্যয় বাড়ানো যায়। সামাজিক সুরক্ষা স্কিম বিস্তৃত করার সময় ভর্তুকির পরিমাণ ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার সুযোগ খোঁজার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে কর্মসূচি বাস্তবায়নে অগ্রগতি পর্যালোচনায় বর্তমানে আইএমএফের একটি রিভিউ মিশন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মিশনটির কর্মকর্তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনায় ভর্তুকি কমিয়ে আনার বিষয়ে জোর দিয়েছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার বলেন, ‘স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব অর্থায়ন বেশি থাকে। বহুপক্ষীয় সংস্থার অর্থায়ন যেখানে থাকে, সেখানে ব্যয়ের গুণগতমান তুলনামূলক ভালো থাকে। যদিও আমাদের নিজস্ব ব্যয়ের গুণগতমান বেশ খারাপ। অন্যান্য দেশের তুলনায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় ব্যয়ের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। তবে সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের ব্যয় বেড়েছে এবং এর ইতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রকৃত সুবিধাভোগীরা এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে কিনা সেটি দেখার বিষয়।’