বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন ও পরিষেবা খাতে গত মাসে কিছুটা শ্লথগতি বিরাজ করেছে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর প্রভাব থাকলেও অন্য খাতগুলো কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান করেছে।
এ কারণে জুনে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল ছিল বলে আর্থিক খাতের বিশ্লেষক সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেস্ক (পিএমআই) বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, এ সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সর্বশেষ ১৩ মাসের মধ্যে দ্বিতীয়-সর্বোচ্চ স্তরে ছিল।
জেপি মরগান গ্লোবাল কম্পিজিট পিএমআই থেকে দেখা যাচ্ছে, মে মাসের সূচক ৫৩ দশমিক ৭ থাকলে পরের মাসে কিছুটা কমে হয়েছে ৫২ দশমিক ৭ পয়েন্ট। সূচকে এ হ্রাসের পেছনে ভূমিকা রেখেছে বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন ও পরিষেবা খাতের মন্থরতা।
পিএমআইয়ের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ ও সংকোচনকে নির্দেশ করা হয়। যেখানে ৫০-এর ওপর হলে সম্প্রসারণ এবং নিচে হলে সংকোচন ধরা হয়। এতে উৎপাদন থেকে সরবরাহসহ ব্যবসায়িক বিভিন্ন ক্ষেত্রের আপস্ট্রিম (উৎপাদনের আগে প্রাথমিক কার্যক্রম) ও ডাউনস্ট্রিম (উৎপাদনের পর ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর কার্যক্রম) অন্তর্ভুক্ত থাকে।
জুনের প্রতিবেদন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগানের বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদ বেনেট পারিস বলেন, ‘খাত ও অঞ্চলজুড়ে মোটামুটি একই ধরনের পতনের সূত্র ধরে গ্লোবাল অল-ইন্ডাস্ট্রি আউটপুট পিএমআই জুনে দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে ৫২ দশমিক ৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে, যা বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রবৃদ্ধির গতি কিছুটা হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। তবু সূচকটি বৈশ্বিক জিডিপি সম্প্রসারণের দৃঢ় গতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।’
তিনি আরো বলেন, ‘নতুন ক্রয়াদেশ হ্রাস ও পিএমআই সূচক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে। তবে কর্মসংস্থান সূচকের উন্নতিতে বাজার উপাদানগুলোর মৌলিকভিত্তির শক্তিমত্তার আভাস দিচ্ছে।’
প্রতিবেদনে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ব্রাজিলে পিএমআই দ্রুত বেড়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আউটপুট দ্রুততম গতিতে সম্প্রসারণ হয়েছে। এ সময় শিল্পোৎপাদন কমলেও সামগ্রিকভাবে ভারসাম্য তৈরি করেছে পরিষেবা খাতের সম্প্রসারণ। অন্যদিকে মে মাসে জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়ে ভারতের অর্থনীতিতে। সেখান থেকে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করেছে দেশটি, যা ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে দিয়েছে ভারতকে। জুনে ১৪ বছরের মধ্যে পণ্য ও পরিষেবা খাতে সবচেয়ে শক্তিশালী পারফরম্যান্স দেখা গেছে দেশটিতে।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের ব্যবসাবিষয়ক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ক্রিস উইলিয়ামসন বলেন, ‘জুনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধিতে সামান্য গতি দেখা গেছে, যা উন্নত বিশ্বে মন্দাভাব ঠেকিয়েছে। একই সময়ে ভারত একটি বিস্তৃত ব্যবধানে উদীয়মান বাজারের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে।’
মে মাসে ব্রাজিলের প্রবৃদ্ধি প্রায় স্থবির ছিল। তবে বার্ষিক হিসেবে জুনে পরিষেবা ও উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই ইতিবাচক অবদান রেখে শক্তিশালী সম্প্রসারণ বজায় রেখেছে ব্রাজিল। অন্যদিকে কানাডায় উৎপাদন কমেছে। এর আগে দুর্বল পরিষেবা খাতের নেতৃত্বে মে মাসে এক বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো সংক্ষিপ্তভাবে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
ক্রিস উইলিয়ামসন আরো বলেন, ‘সাত মাসের মধ্যে জাপানে প্রথমবার প্রবৃদ্ধির পতন দেখা গেছে। অবশ্য এটি বেশ প্রান্তিক ঘটনা। ২২ মাসের জন্য প্রথমবারের মতো পরিষেবা খাতের উৎপাদন কমেছে। তবে ১৩ মাসের মধ্যে প্রথমবারের জন্য শিল্পোৎপাদন আউটপুট বৃদ্ধি পরিষেবা খাতের পতনকে আংশিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ করেছে।’
অন্যদিকে রাশিয়ায় উৎপাদনে কিছুটা সংকোচন ঘটেছে, যা ১৭ মাসের মধ্যে প্রথম পতনকে চিহ্নিত করেছে। এতে প্রভাব রেখেছে পরিষেবা কার্যকলাপ। তবে উৎপাদন খাত স্থিতিশীল। চীনে প্রবৃদ্ধিও মন্থর হয়েছে। জুনে দেশটিতে শিল্পোৎপাদন খাত জোরালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও পরিষেবা খাতে শ্লথতা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া টানা অষ্টম মাস সম্প্রসারণ হয়েছে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি। তবে উৎপাদন ও পরিষেবা খাতে প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়েছে। ফলে চলতি বছরের সবচেয়ে দুর্বল প্রবৃদ্ধি ঘটেছে জুনে। এজন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যয় কমার প্রবণতা আংশিকভাবে দায়ী বলে জানিয়েছে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল।
এদিকে জ্বালানি তেলবহির্ভূত বেসরকারি খাতে শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি দেখেছে মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ অর্থনীতি সৌদি আরব। দেশটির পিএমআই পয়েন্ট ছিল ৫৫। এ সম্প্রসারণের পেছনে রয়েছে চাহিদার বৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধি ও চাকরির বাজারে ঊর্ধ্বগতি।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, সম্প্রসারণের মন্থরতার মধ্যে বৈশ্বিক সব সাব-সেক্টরে প্রবৃদ্ধি আরো বিস্তৃত হয়েছে। পিএমআইয়ে অন্তর্ভুক্ত ২৫টি সাব-সেক্টরের সবই ২০২১ সালের জুলাইয়ের পর প্রথমবারের মতো জুনে বিশ্বব্যাপী সংকোচন এড়িয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আর্থিক পরিষেবা বিভাগে উৎপাদন দ্রুতগতিতে বেড়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়িক পরিষেবা, ভোগ্যপণ্য ও মধ্যবর্তী পণ্য খাতেও দৃঢ় সম্প্রসারণ দেখা গেছে। সূত্র: আরব নিউজ।