রাতে ফরেস্ট সিটি অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায়। শহরের প্রত্যেক ব্লকে শত শত অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, কিন্তু আধা ডজনের চেয়ে বেশি অ্যাপার্টমেন্টে বাতি জ্বলতে দেখা যায় না। এখানে যে মানুষ বাস করে, সেটি বিশ্বাস করাই কঠিন। ফরেস্ট সিটির নির্মাতা কোম্পানি কান্ট্রি গার্ডেনের ঋণ বর্তমানে ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে, তারপরও প্রকল্পটি শেষ করার ব্যাপারে আশাবাদী এটি।
“আমি সেখান থেকে পালাতে পেরেছিলাম,” ভয়-মিশ্রিত হাসিতে বললেন নাজমি হানাফিয়াহ।
এক বছর আগে তথ্য-প্রযুক্তি প্রকৌশলী নাজমি ‘ফরেস্ট সিটি’র এক ব্লকে এক বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তার বেডরুম থেকে সাগরও দেখা যায়। চীনারা দক্ষিণ মালয়েশিয়ার উপকণ্ঠে অবস্থিত জোহরে ফরেস্ট সিটি নামের এ আবাসিক এলাকাটি নির্মাণ করে।
ছয় মাসেই নাজমি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। তিনি আর এ শহরে থাকতে চাননি। এমনকি তিনি এ শহরকে ‘ভূতুড়ে শহর’ আখ্যা দেন।
তিনি বলেন, “আমি আমার ডিপোজিট নিয়ে ভাবিনি, অর্থ নিয়ে ভাবিনি। আমি শুধু চেয়েছিলাম সেখান থেকে চলে আসতে।”
তিনি বলেন, “সেখানে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবলে আমি এখনো আঁতকে উঠি। শহরটির চারদিক একেবারে নির্জন। সেখানে শুধু আমি আর আমার চিন্তা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।”
২০১৬ সালে চীনের সর্ববৃহৎ প্রোপার্টি ডেভেলপার ‘কান্ট্রি গার্ডেন’ শহরটি উদ্বোধন করে। এটি ছিল চীনের রোড এন্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভের অধীনে একটি মেগা প্রকল্প।
এই সময় চীনের রিয়াল এস্টেট খাতের প্রবৃদ্ধি ঘটছিল পুরোদমে। প্রকল্পটির জন্য নির্মাতারা দেশ-বিদেশ থেকে ব্যাপক পরিমাণ অর্থ ঋণ নেন। তারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য শহরটি নির্মাণ করেন।
কান্ট্রি গার্ডেনের পরিকল্পনা ছিল একটি পরিবেশ-বান্ধব শহর গড়ে তোলা, যেখানে থাকবে গল্ফ কোর্স, ওয়াটার পার্ক, অফিস, বার এবং রেস্টুরেন্ট। কোম্পানিটি বলেছিল, শহরটিতে দশ লক্ষ মানুষ বাস করতে পারবেন।
আট বছর চলে গেছে। কিন্তু এটি একটি ব্যর্থতার স্মারক হিসেবেই রয়ে গেছে। চীনের প্রোপার্টি সংকট বুঝতে আপনাকে চীনে থাকার দরকার নেই। ফরেস্ট সিটি প্রকল্পের বর্তমানে ১৫ শতাংশ নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু মাত্র এক শতাংশের কিছু বেশি অংশে মানুষ বাস করছেন।
যদিও বর্তমানে কান্ট্রি গার্ডেনের ঋণ ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছে, তারপরও প্রকল্পটি শেষ করার ব্যাপারে কোম্পানিটি আশাবাদী।
‘গা ছমছমে’
ফরেস্ট সিটিকে ‘সকল মানবজাতির জন্য ড্রিম প্যারাডাইজ’ হিসেবে উল্লেখ করা হতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নির্মাতাদের লক্ষ্য ছিল এখানে চীনা স্থানীয় পণ্যের বাজার তৈরি করা। এর মাধ্যমে তারা মূলত উচ্চাভিলাষী মানুষদের বিদেশে দ্বিতীয় একটি বাড়ির মালিক হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এর বিক্রয়মূল্য এত বেশি যে, মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষের জন্য তা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
চীনা ক্রেতাদের কাছে এখানে জায়গা কেনা বিনিয়োগ হিসেবেই গণ্য হয়। কারণ নাজমির মতো স্থানীয় মালয়েশিয়ানদের কাছে তারা তা ভাড়া দিতে পারবেন।
ফরেস্ট সিটি নির্মাণ করা হয়েছে একটি দ্বীপে। এর কাছাকাছি বড় শহর জোহর বাহরু ফরেস্ট সিটি থেকে বেশ দূরে। ফলে এর অবস্থান লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে শহরটি সম্ভাব্য বাসিন্দাদেরও আর আকর্ষণ করতে পারছে না। এজন্য স্থানীয় মানুষ শহরটিকে এখন ‘ভূতুড়ে শহর’ নামে ডাকে।
নাজমি বলেন, “সত্যিকার অর্থে স্থানটি ছিল আতঙ্কজনক। আমার অনেক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু আমি খারাপ অভিজ্ঞাতার মুখোমুখি হই। সেখানে আমার কিছুই করার ছিল না।”
ফরেস্ট সিটির পরিবেশ খুবই অদ্ভূতুড়ে—দেখে মনে হয় একটি পরিত্যক্ত রিসোর্ট। জন-মানবহীন এখানকার সৈকত হয়ে উঠেছে যত্নহীন শিশুর খেলার মাঠ, পড়ে আছে মরিচা-পড়া গাড়ি। কুমিরের ভয়ে এখানকার পানিতে সাঁতার কাটাও যায় না।
ফরেস্ট সিটি’র মলের বেশিরভাগ দোকান ও রেস্তোরাঁ বন্ধ। ছবি: গেটি ইমেজেস ভিয়া বিবিসি
শপিংমলগুলোতে দোকানপাট বা রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ। কিছু নির্মাণ এলাকা একদম খালি।
রাতে ফরেস্ট সিটি অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায়। শহরের প্রত্যেক ব্লকে শত শত অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, কিন্তু আধা ডজনের চেয়ে বেশি অ্যাপার্টমেন্টে বাতি জ্বলতে দেখা যায় না। এখানে যে মানুষ বাস করে, সেটি বিশ্বাস করাই কঠিন।
জোয়ান কাউর বলেন, “স্থানটি ভূতুড়ে। এমনকি দিনে যখন সদর দরজার বাইরে আসি, দেখি, করিডোর অন্ধকার।”
তিনি আর তার স্বামী একটি টাওয়ার ব্লকের আটাশ তলায় থাকেন। কিন্তু পুরো ফ্লোরে তারা ছাড়া আর কেউ নেই। তারাও নাজমির মতো ভাড়াটে এবং যত দ্রুত সম্ভব স্থানটি ত্যাগ করার কথা ভাবছেন।
“যারা এখানে জায়গা কিনেছে ও বিনিয়োগ করেছে, তাদের জন্য আমার দুঃখ হয়। আপনি যদি ‘ফরেস্ট সিটি’ লিখে গুগল করেন, তবে এখন যা দেখছেন, সেখানে তেমন পাবেন না”, তিনি বলেন।
তিনি আরও বলেন, “মানুষকে যেমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, প্রকল্পটি তেমনই হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তেমনটা হয়নি।”
চীনের যেসব লোকজন এখানে জায়গা কিনেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলা খুব সহজ নয়। তারপরও বিবিসি বেশ কয়েকজনের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা এমনকি অজ্ঞাত নামেও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কিছু পোস্টে ফরেস্ট সিটি সম্পর্কে কিছু প্রমাণ পাওয়া গেছে। লিয়াওনিং প্রদেশের এক ক্রেতা এক পোস্টে লিখেছেন, “এটি বিভ্রান্তিকর। ফরেস্ট সিটি বর্তমানে ভূতুড়ে টাউন। মোটের ওপর এখানে কোনো মানুষ নেই। এটি শহর থেকে অনেক দূরে, বসবাস করার মতো সকল সুযোগ-সুবিধা এখানে নেই। এখানে গাড়ি ছাড়া চলাচল করা খুবই কঠিন।”
বিক্রি নেই বললেই চলে
এ ধরনের হতাশা পুরো চীনে বিরাজ করছে, দেশটিতে প্রোপার্টি মার্কেটে তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খল অবস্থা।
ডেভেলপাররা অধিক হারে ঋণগ্রহণ করায় চীন সরকার ভীত হয়ে পড়ে। অবশেষে সরকার ২০২১ সালে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিং পিংয়ের মূলমন্ত্র হলো, “বাড়ি বসবাসের জন্য, ফটকাবাজির জন্য নয়।”
সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে অনেক কোম্পানি অর্থের অভাবে বড় বড় প্রকল্প শেষ করতে পারছে না।
অক্টোবরে কান্ট্রি গার্ডেনকে অস্ট্রেলিয়ায় দুটি প্রকল্প ছেড়ে আসতে বাধ্য করা হয়। তারা অসমাপ্ত এ প্রকল্প দুটি বিক্রি করে দেয়, যার একটি সিডনিতে ও অন্যটি মেলবোর্নে অবস্থিত।
স্থানীয় রাজনীতিও ফরেস্ট সিটির বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ চীনা ক্রেতাদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দেন। দেশের মাটিতে বিদেশিদের জন্য শহর বানানোয় তার আপত্তি ছিল।
যে দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল, সে দেশে এ ধরনের মেগা প্রকল্প নির্মাণের পরিকল্পনা করায় উদ্যোক্তাদের প্রজ্ঞা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কিছু বিশ্লেষক। মালয়েশিয়ার বর্তমান সরকার ফরেস্ট সিটি প্রকল্পের প্রতি সহায়ক হলেও, একজন ভবিষ্যৎ ক্রেতার কাছে এটি অস্পষ্ট যে, সরকার এই সুবিধা কতদিন ও কী পরিসরে দেবে।
এছাড়া করোনা অতিমারীতে চলাচল ও বিদেশে অর্থ ব্যয়ের ওপর চীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের মতো কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যাও কান্ট্রি গার্ডেনের এ প্রকল্পের অগ্রগতিতে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
“আমার মনে হয়, তারা প্রকল্পের বিষয়ে একটু তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে”, বলেন কেজিবি ইন্টারন্যাশনাল প্রোপার্টি কনসালট্যান্টসের তান উই তিয়াম। তিনি বলেন, “এটির মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতে অবশ্যই অর্থের যোগানের বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।”
চীনের প্রোপার্টি মার্কেটে বর্তমান পরিস্থিতিকে কান্ট্রি গার্ডেন নিছক নয়েজ বা বিশৃঙ্খলা হিসেবে দেখছে। তারা মনে করে, মালেয়েশিয়ায় তাদের গৃহীত প্রকল্পই তাদের ব্যবসাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
ফরেস্ট সিটিকে মালয়েশিয়া ও প্রতিবেশী সিঙ্গাপুরের মাঝে নতুন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলাই এখন কান্ট্রি গার্ডেনের পরিকল্পনা, যা প্রকল্পটিকে স্থিতিশীল ও নিরাপদ করে তুলবে।
কিন্তু অর্থের যোগান না থাকায় প্রকল্পটি শেষ করা ও এখানে বসবাসের জন্য মানুষকে আকর্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ সময় চীনা কোম্পানি কর্তৃক নির্মিত প্রোপার্টি বিক্রি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আরইডিডি ইন্টেলিজেন্স, এশিয়া-এর ইভেলিন দনুব্রতের মতে, “এটি ডিম আগে নাকি মুরগি আগের মতো অবস্থা।” তিনি বলেন, “একজন ডেভেলপার তার নির্মাণ কাজে অর্থায়নের জন্য অগ্রিম-বিক্রয়ের উপর নির্ভর করে। কিন্তু ক্রেতারা নির্মাতাকে অগ্রিম অর্থ দেবে না, যদি তারা শেষ পর্যন্ত অ্যাপার্টমেন্টের চাবি হাতে পাওয়ার নিশ্চয়তা না পায়।”
উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা
যখন চীনের প্রোপার্টি সংকটের বিষয়টি সামনে আসে, তখন প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির একটি ক্লাসিক ঘটনা হিসেবে ‘ফরেস্ট সিটি’ নিয়ে কথা বলা যায়। কিছু স্থানীয় বিষয় বর্তমান পরিস্থিতির জন্য কিছুটা দায়ী হলেও এটি প্রমাণিত যে, দূরবর্তী ও নিরস জায়গায় হাজার হাজার অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করে মানুষকে সেখানে বসবাসের জন্য আকর্ষণ করা সম্ভব নয়।
ফরেস্ট সিটি ও চীনের শত শত প্রকল্পের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা নির্ভর করছে চীন সরকারের ওপর। গত মাসে প্রকাশিত বেশ কিছু প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তাতে দেখা যায়, ডেভেলপার নিয়ে করা সরকারের প্রাথমিক তালিকায় স্থান পেয়েছে কান্ট্রি গার্ডেন, যারা চীন সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পেতে পারে, যদিও এ সহায়তার পরিমাণ কী হবে, তা স্পষ্ট নয়।
তারপরও এখানে নাজমির মতো লোকেদের ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, “এরপর আমি অনেক সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নেব। কিন্তু আমি খুশি যে, আমি স্থানটি ত্যাগ করতে পেরেছি। আমি আমার জীবন ফিরে পেয়েছি।”