এপ্রিল মাসের তীব্র দাবদাহে সারা দেশের জনজীবন বিপর্যস্ত। মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে প্রতিদিনই দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি বা তার বেশি থাকছে। প্রচণ্ড গরমে নির্মাণ খাতের কাজের গতি কমেছে। তার প্রভাবে নির্মাণসামগ্রী বিক্রিও কমে গেছে। এ ছাড়া কিছু শিল্পকারখানায় গরমের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
যদিও তীব্র দাবদাহের প্রভাব একেক খাতে একেক রকম। নির্মাণ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, গরমের কারণে নির্মাণশ্রমিকেরা টানা কাজ করতে পারছেন না। ফলে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো প্রকল্পের কাজের গতি কমে গেছে। তার কারণে রড-সিমেন্টের চাহিদাও কমেছে। অন্যদিকে রফতানীমুখী পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রতিষ্ঠানভেদে ডাইং ও নিটিং ইউনিটে কিছুটা প্রভাব পড়েছে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, চলতি এপ্রিল মাসে দেশে টানা যত দিন তাপপ্রবাহ হয়েছে, তা গত ৭৬ বছরে হয়নি। গত বছর (২০২৩) একটানা ১৬ দিন তাপপ্রবাহ হয়েছিল। এবার তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে ১ এপ্রিল থেকে। গত শনিবারও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাপপ্রবাহ বইছে।
আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান ক্রিডেন্স হাউজিং লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, বনানী, গুলশান, উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিল্লুল করিম বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহে নির্মাণশ্রমিকেরা একটানা দীর্ঘ সময় কাজ করতে পারছেন না। ফলে কাজের গতি কিছুটা ধীর হয়েছে। ঈদের পর নির্মাণশ্রমিকদের অধিকাংশই এখনো ফেরেননি। প্রকল্পগুলোতে ৩০ শতাংশ শ্রমিক কাজ করছেন। সব শ্রমিক কাজে থাকলে ধীরগতির কারণে আর্থিক ক্ষতি বেশি হতো।
জানতে চাইলে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, প্রচণ্ড গরমে আবাসন প্রকল্পের নির্মাণকাজের গতি কমে গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান দিনের কাজ রাতেও করাচ্ছে।
নির্মাণ খাতের কাজের গতি কমে যাওয়ায় রড, সিমেন্ট, টাইলসসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রীর চাহিদা কমে গেছে। ফলে উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন শিল্পকারখানার উদ্যোক্তারা। উৎপাদনপ্রক্রিয়া অটোমেশন হওয়ায় রড, সিমেন্ট ও টাইলসের আধুনিক কারখানাগুলোতে তীব্র গরমে উৎপাদন সেভাবে ব্যাহত হয়নি। তবে শ্রমিকদের কায়িক পরিশ্রম আছে এমন কাজে গতি কমেছে। তাতে সামগ্রিক উৎপাদন কমেছে।
ঢাকার কোনাপাড়া এলাকার শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম বলেন, উৎপাদন প্রক্রিয়া অটোমেশন হওয়ায় সেখানে সমস্যা হচ্ছে না। তবে শ্রমিকেরা রড বান্ডিল করা ও ট্রাকে লোড-আনলোড করেন। সেই কাজগুলোতে প্রচণ্ড গরমে সমস্যা হচ্ছে। তা ছাড়া আগে থেকেই লোডশেডিং ও গ্যাস সংকট রয়েছে। সব মিলিয়ে ২০ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে।
অবশ্য বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গরম হলেও অটোমেশনের কারণে স্টিল ও সিমেন্ট কারখানার তেমন সমস্যা হচ্ছে না। তবে নির্মাণকাজের গতি কমে যাওয়ায় রডের বিক্রি ৩০-৩৫ শতাংশ এবং সিমেন্টের বিক্রি ১০ শতাংশের মতো কমেছে। তাতে আমাদের গুদামে পণ্যের মজুত বাড়ছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস গত বছর বাংলাদেশে অতি উষ্ণ তাপমাত্রার প্রভাব নিয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত করে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশে গরমের কারণে তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তারা আগের চেয়ে কম কাজ করতে পারছেন। তাঁদের স্বাস্থ্যেরও ক্ষতি হচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবে জাতীয় উৎপাদন কমে আসছে।
চলমান দাবদাহে তৈরি পোশাকশিল্পে কী প্রভাব পড়ছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, সুইং সেকশনে বা সেলাই বিভাগের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে ডাইং সেকশনে উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন হওয়ায় এই গরমে শ্রমিকেরা অল্প সময়েই ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছেন। শ্রমিকেরা যাতে ডিহাইড্রেডে না ভোগেন, সে জন্য স্যালাইন সরবরাহ করা হয়। তারপরও ডাইং সেকশনে প্রতিদিন গড়ে ৫০ শতাংশ শ্রমিক অনুপস্থিত থাকছেন। তাতে ২৫-৩০ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ বেনজির আহমেদ বলেন, যখন বেশি তাপপ্রবাহ থাকে, তখন কাজে বিরতি দেওয়া যেতে পারে। কৃষি, নির্মাণ ও ইটভাঙার শ্রমিকদের সকালে ও সন্ধ্যায় কাজ করানো দরকার। দুপুরে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। আর যদি শ্রমিকদের কাজে বিরতি দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে পর্যাপ্ত ফ্যানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বাতাসের প্রভাব থাকে। সুপেয় পানির বন্দোবস্ত করতে হবে। মাঝেমধ্যে লবণ পানির শরবত খাওয়াতে হবে শ্রমিকদের। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে গরম কমবে না; বরং বাড়বে। ফলে এখন থেকে গরম প্রশমনে শিল্পকারখানাগুলোকে পরিকল্পনা করতে হবে।