ইউরোপজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক শ্লথতা ও এর ভবিষ্যৎ ঝুঁকি নিয়ে সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়েছেন অঞ্চলটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নির্বাহীরা।
তাদের মতে, বিদ্যমান ঝুঁকির অগ্রভাগে রয়েছে সাম্প্রতিক বাণিজ্য উত্তেজনা ও উচ্চ সরকারি ঋণ। এর সঙ্গে ফরাসি নির্বাচনে অতিডানপন্থীদের উত্থান নিয়ে সতর্ক করেছে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি)। সম্প্রতি পর্তুগালে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠক থেকে তারা এ সতর্কবার্তা দিয়েছেন।
মূল্যস্ফীতি কমানো ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দ্বৈরথে ভুগছে বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলো। বিশেষ করে ইউরোপের অর্থনীতিতে এর চাপ বেশি। এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ফ্রান্সের সংসদ নির্বাচনের প্রথম দফায় মারিন লু পেনের অতিডানপন্থী ইউরোসেপ্টিক পার্টির বিজয়। কারণ সরকারি ব্যয় বাড়ার প্রতিশ্রুতিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে দলটির প্রচারণায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আলোচনায় এ বিষয়ে উদ্বেগ উঠে এসেছে।
এ বিষয়ে ইসিবির পরিচালনা পর্ষদ যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। ২০২২ সালে সরকারি ঋণ সংকটের কারণে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য নীতি নিয়ে সতর্ক করে দেন বেলজিয়ামের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পিয়েরে ওয়ানশ। তার মতে, দেশ দুটি ভর্তুকি ও শুল্ক সুবিধা নিয়ে ইউরোপের বাজারের দিকে যেভাবে এগোচ্ছে, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
পিয়েরে ওয়ানশের ভাষ্য, ‘আমরা এমন এক বৈশ্বিক পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছি, যা অনেক বেশি পরিবর্তনশীল ও বেশির ভাগ ব্যবস্থাই স্বল্পমেয়াদি। এটি ইউরোপের জন্য সংকটজনক। এ পরিস্থিতিতে পথ দেখানোর মতো স্পষ্ট নির্দেশনাও আমাদের নেই।’
সম্প্রতি চীনের বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি (ইভি) ও সেমিকন্ডাক্টরসহ বিভিন্ন পণ্যের আমদানির ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর পর পরই চীনা ইভি আমদানিতে উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছে ইইউ। এর বিপরীতে বেইজিং পদক্ষেপ নেয়ার হুমকি দিয়েছে। এতে ইউরোপ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হতে পারে।
অন্যদিকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে ইউরোপীয় আমদানির ওপর অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর প্রস্তাব দিয়েছে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ হিসেবে মার্কিন নির্বাচনে তিনি জয়ী হলে বাণিজ্য উত্তেজনা তীব্র হতে পারে। ইউরোজোনের জিডিপিতে ভূমিকা রাখা অর্ধেকেরও বেশি পণ্য রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে বাণিজ্যযুদ্ধে অঞ্চলটি বিশেষ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
সম্মেলনে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ জানান, ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পিত শুল্ক আরোপ হলে তা ইউরোজোনের অর্থনীতিকে গুরুতরভাবে আঘাত করবে। এতে ব্লকের জিডিপি ১ শতাংশ হ্রাস পাবে। অন্যদিকে মার্কিন জিডিপিতে এর প্রভাব হবে মাত্র দশমিক ১ শতাংশ। এ ধরনের একটি ধাক্কা ইউরোজোনের প্রত্যাশিত দশমিক ৯ শতাংশ জিডিপিকে ম্লান করার জন্য যথেষ্ট।
অবশ্য ভর্তুকি ও শুল্ক বিষয়ে সবার সমান সুযোগের ওপর গুরুত্ব দেন পিয়েরে ওয়ানশ। তবে এও স্মরণ করিয়ে দেন, বাকি বিশ্বের সঙ্গে ইউরোপের আকাঙ্ক্ষা আলাদা হওয়ায় এ ধরনের পরিস্থিতিগুলো খুবই চ্যালেঞ্জপূর্ণ।
বিশেষ করে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভাজন নিয়ে উদ্বিগ্ন বলে জানান আয়ারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর গ্যাব্রিয়েল ম্যাকলফ। তার মতে, ‘পরিস্থিতি আরো সংকটপূর্ণ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।’ যা সরবরাহ চেইনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন তিনি। এতে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে ছোট দেশগুলো।
সম্মেলনে দেশগুলোর বাজেট ঘাটতি নিয়ে সতর্ক করে দেন স্লোভেনিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বস্তজান ভাসলে। ইইউর নতুন নিয়ম অনুসরণ করে ঘাটতি মোকাবেলায় জোর দেন তিনি, না হলে বাজেট ঘাটতির বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েই যাবে।
ফরাসি নির্বাচন সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য না করেই বস্তজান ভাসলে বলেন, ‘রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে ইউরো এলাকায় স্থিতিশীলতা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাছে এমন উপায় (ইইউ) রয়েছে, যা এ অঞ্চলের আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় হস্তক্ষেপের অনুমতি দেবে। কিন্তু বাজার এখনো ততটা অযৌক্তিক ও উচ্ছৃঙ্খল পর্যায়ে নেই।’
বেশকিছু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে বাজারের মন্দার ঝুঁকি পরবর্তী ফরাসি সরকারকে ব্যয়ের স্রোতে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে যথেষ্ট হবে।
এ বিষয়ে গ্যাব্রিয়েল ম্যাকলফ বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি সব সরকারই বুঝতে পারে যে দেশ শাসন ও প্রচারণার বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এটি বোঝার জন্য শুধু লিজ ট্রাসের দিকে তাকালেই হবে।’
এদিকে ইউরোজোনের মূল্যস্ফীতি নিয়ে নীতিনির্ধারকরা একমত যে এর গতি ঠিক দিকে যাচ্ছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত তথ্য দেখাচ্ছে, ইউরোজোনের মূল্যস্ফীতি জুনে ২ দশমিক ৫ শতাংশের দিকে রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদহার স্থগিত রাখার বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত অবস্থানে রয়েছে। সূত্র: ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস।