বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, মহামারী, বৈশ্বিক অস্থিরতা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার এখন ৬ শতাংশ। এ বৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য দেশের সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন, যেখানে নির্মাণ শিল্পের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশীদের মাথাপিছু ইস্পাত খরচ ২০২০ সালে ছিল ৪৫ কেজি, যা ২০৩০ সালের আগেই ১০০ কেজিতে পৌঁছে যেতে পারে। এ ক্রমবর্ধমান চাহিদাই প্রমাণ করছে দেশে ইস্পাত শিল্প বিকাশের প্রয়োজনীয়তা। ১৯৫২ সালে আকবরআলী আফ্রিকাওয়ালা ও তার চার ভাইয়ের হাত ধরে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। তাদের প্রতিষ্ঠানই বর্তমানে বাংলাদেশ স্টিল রি রোলিং মিলস বা BSRM নামে পরিচিত এবং দেশের ইস্পাত শিল্পকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাজারে আরো আছে কেএসআরএম, একেএস, জিপিএইচ, আনোয়ার ইস্পাত, রহিম স্টিল, এসসিআরএম, জেডএসআরএম, গোল্ডেন ইস্পাতসহ প্রায় ২০০টি ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান।
এদিকে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্প অত পুরনো না হলেও দেশে সিমেন্ট শিল্পের গোড়াপত্তন হয় ইস্পাতের আগেই। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির হাত ধরে ১৯৪১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ক্ষমতাধীন ভারতবর্ষের সিলেটে প্রথম সিমেন্ট উৎপাদন শুরু হয়। আগে এ কোম্পানির নাম ছিল আসাম বেঙ্গল সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে দেশের দ্বিতীয় সিমেন্ট ফ্যাক্টরি গড়ে ওঠে চট্টগ্রামে চিটাগং সিমেন্ট ক্লিংকার অ্যান্ড গ্রাইন্ডিং ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বর্তমানে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট) নামে।
নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন বিনিয়োগ বাড়ায় দেশের নির্মাণ শিল্পে ঘটে যায় ছোটখাটো বিপ্লব। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্পের কাঠামোকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পরিণত করে। চট্টগ্রামের বড় ইস্পাত ও সিমেন্ট কারখানার পাশাপাশি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জভিত্তিক নির্মাণ ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নতুন প্রযুক্তির সমন্বয়ে কারখানা স্থাপন করে বাজারে পা রাখে এ সময়। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির বড় একটা অংশজুড়ে রয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে গড়ে ওঠা ইস্পাত ও সিমেন্টের বড় এ শিল্প-কারখানাগুলো যাদের মাঝে অনেকেই নিজেদের পণ্য রফতানি করছে বিদেশে।
এদিকে আধুনিক যুগে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণ শিল্পে বড় স্থান দখল করে নিতে শুরু করে কাচ ও সিরামিক টাইলস। বাংলাদেশে কাচ, বিশেষ করে শিট, ফ্ল্যাট আর ফ্লোট গ্লাস যা কিনা আবাসিক ও বাণিজ্যিক উভয় ধরনের ভবনে ব্যবহার হয় তার বাজার দিন দিন বাড়ছে রকেটের গতিতে, যা শুরু হয় এ শতাব্দীর শুরুতে। বাংলাদেশে মূলত কনভেনশনাল শিট গ্লাস প্রযুক্তিতে কাচ তৈরি করা হতো সরকারি তত্ত্বাবধানে উসমানিয়া শিট গ্লাস ফ্যাক্টরিতে। তখন দেশের চাহিদার প্রায় সম্পূর্ণ কাচ আমদানি করতে হতো। পরবর্তী সময়ে নতুন ফ্লোট গ্লাস প্রযুক্তি নিয়ে নাসির গ্রুপ আর পিএইচপি কাচ উৎপাদনে যুক্ত হয়। বর্তমানে দেশে ছোট-বড় প্রায় ৫০টি কাচ কারখানা রয়েছে, যারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও কাচ রফতানি করছে।
সিরামিক শিল্প তুলনামূলক পুরনো কাচের চেয়ে। প্রায় সাড়ে ছয় দশক আগে এ ভূখণ্ডে সিরামিক পণ্যের উৎপাদন শুরু হয়। তবে টাইলসের যাত্রাটা শুরু হয় আরো পরে। ১৯৯৩ সালে মধুমতি সিরামিকস দেশে প্রথম টাইলস কারখানা স্থাপন করে। তারপর গত তিন দশকে বাজারে আসে বেশকিছু কোম্পানি। তবে সিরামিক খাতের বেশির ভাগ বিনিয়োগ এসেছে ২০০০ সালের পর, অর্থাৎ গত দুই যুগে। এ খাতের কারখানাগুলোর মধ্যে ৬০টিই গত দুই দশকে প্রতিষ্ঠিত। দেশে সিরামিকের বাজার বৃদ্ধির পেছনে সরকারের নেয়া বিভিন্ন নীতিসহায়তা সহায়ক ছিল বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশের নির্মাণ শিল্পের আরেকটি বড় অংশজুড়ে আছে রঙ ও কোটিং। বহুজাতিক কোম্পানি যেমন বার্জার, এশিয়ান পেইন্টস ইত্যাদির পাশাপাশি দেশে রক্সি, এলিট ইত্যাদি রঙ কোম্পানি বিদ্যমান যারা দুই দশকের বেশি সময় ধরে রঙ ও কোটিং শিল্পের প্রবৃদ্ধি ধরে দেখে দেশের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে।
দেশের নির্মাণ ও স্থাপত্য শিল্পের এ উপাদানগুলোর বর্তমান বাজার যথেষ্ট বড়। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি অংশজুড়ে আছে ইস্পাত, বর্তমানে যার আকার প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে দেশে ব্যবহৃত হয়েছিল ৩ কোটি ৮০ লাখ টন সিমেন্ট, যার পরিমাণ সামনে আরো বাড়বে। সমগ্র পৃথিবীর হিসাবে বাংলাদেশের সিমেন্ট বাজারের অবস্থান বিশ্বে ৪০তম। এদিকে কাচ শিল্পের বর্তমান বাজারের পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা, যার মাঝ থেকে রফতানির মাধ্যমে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ আয় করেছে প্রায় ১৪ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার। পাশাপাশি গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) দেশে প্রায় ৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকার টাইলস বিক্রি হয়েছিল এবং Coatings World নামের একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্যমতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের পেইন্টস ও কোটিং শিল্পের আকার ছিল ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি (৪৭১ মিলিয়ন ডলার)। বাজারের উপাত্তগুলো দেশের শিল্প খাতে নির্মাণ ও স্থাপত্যসামগ্রীর সম্ভাবনা ও প্রভাবের একটি চিত্র তুলে ধরে নিঃসন্দেহে। পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, রাজনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সচেতনতা এ খাতকে গড়ে তুলতে পারে দেশের পরবর্তী সবচেয়ে বড় রফতানিমুখী খাত হিসেবে।