রাজধানীর পূর্বাচলের জনপ্রিয় হাউজিং প্রবাসী পল্লীতে প্রথমআলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের উদ্যোগে বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রাণ ও প্রকৃতির মধ্যে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ থেকেই এ বছর বন্ধুসভার নিয়মিত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শহীদদের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়।
‘আমার মাটি, আমার দায়; গাছ রোপণে বাঁচা যায়’ প্রতিপাদ্যে গত ৮ জুন থেকে তিন মাসব্যাপী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি শুরু হলেও জুলাই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আগস্টে নতুন বাংলাদেশে ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স ৭০ হাজার গাছের চারা নিয়ে এই কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জুলাই-আগস্টে অকুতোভয় যেসব ছাত্র-জনতা দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, মুক্তির জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের স্মরণে এবারের কর্মসূচি উৎসর্গ করা হবে।
এবারের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য ছিল গাছ রোপণের পাশাপাশি সেগুলোর যত্ন ও পরিচর্যা। সে লক্ষ্যে কর্মসূচির শুরুতেই ফেসবুক লাইভে এ বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেন কর্মসূচির সমন্বয়ক ও জাতীয় পর্ষদের নির্বাহী সভাপতি মৌসুমী মৌসহ সভাপতি জাফর সাদিক ও সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসাইন মল্লিক এবং অন্য সমন্বয়কেরা। পরিবেশবান্ধব বৃক্ষ ও সেগুলোর উপকারিতা বর্ণনা এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বৃক্ষ সম্পর্কে বন্ধুদের জানান সাংগঠনিক সম্পাদক।
এরপর সারা দেশের বন্ধুসভার চাহিদা অনুযায়ী জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ থেকে ব্র্যাকের সৌজন্যে গাছের চারা পাঠানো হয়। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁও বন্ধুসভা জিলা স্কুল বড় মাঠে গাছের চারা রোপণ করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিটি কর্মসূচি এখান থেকেই শুরু হয়েছিল এবং জুলাই আন্দোলনে এখানকার অনেক গাছ ভেঙে গিয়েছিল। নতুন বাংলাদেশে ‘সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য’ গাছের চারা রোপণ করে ঝালকাঠি বন্ধুসভা। রায়গঞ্জ বন্ধুসভার উদ্যোগে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ‘মাহাতো’ সম্প্রদায়ের কুড়মালি পাঠশালার শিক্ষার্থীদের মধ্যে গাছের চারা বিতরণ এবং গাছের চারা রোপণ করা হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরের বাবুডাইং আলোর পাঠশালা প্রাঙ্গণে বৃক্ষরোপণ ও চারা বিতরণ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভা। এ ছাড়া কুমিল্লা, সৈয়দপুর, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন বন্ধুসভা সপ্তাহব্যাপী কিংবা কয়েক দফায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে।
আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন—এই চার মাসজুড়ে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালিত হয়। সারা দেশের ১০০টি বন্ধুসভা এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। বন্ধুরা নিজেদের অর্থের পাশাপাশি ব্র্যাক মাইক্রোফ্যাইন্যান্সের সহযোগিতায় সারা দেশে ১ লাখ ৫ হাজার ১৩৮টি গাছ রোপণ করেন। এর মধ্যে ব্র্যাক বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ৭০ হাজার গাছের চারা সরবরাহ করেছে। রোপণ করা গাছের মধ্যে ছিল জলপাই, পেয়ারা, পেঁপে, আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, আমলকী, চালতা, কমলা, লেবু, তেঁতুল, লিচু, কৃষ্ণচূড়া, মহুয়া, কাঞ্চন ফুল, বকুল, পলাশ, দেবদারু, কদম, পেয়ারা, হরীতকী, বহেরা, অর্জুন, নিম, মেহগনি, কড়ইসহ বিভিন্ন প্রজাতির ৫৮ হাজার ৫৪৬টি ফলদ, ২২ হাজার ৮৮৫টি বনজ ও ২৩ হাজার ২০৭টি ঔষধি গাছের চারা।
বৃক্ষরোপণে বন্ধুদের উদ্যোগসহ সার্বিক বিষয়ে জাতীয় পর্ষদের সভাপতি জাফর সাদিক বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন তরুণেরা দেখেছে, তার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন থেকেই এবারের কর্মসূচি আমরা শহীদদের উদ্দেশে উৎসর্গ করছি। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় রোপন করা প্রতিটি গাছের চারা সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করে বাঁচিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে আমরা শহীদদের স্মরণ করতে চাই, মাতৃভূমির প্রতি দায় শোধ করতে চাই। আমাদের এই উদ্যোগে ব্র্যাকের সহযোগিতা কর্মসূচির কলেবর বৃদ্ধি করতে সহযোগিতা করেছে।’
প্রতিবারই বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য বজায় রাখতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী গাছের চারা বাছাই করা হয়। এ বিষয়ে মৌসুমী মৌ বলেন, ‘সঠিক সময়ে গাছের চারা রোপণ এবং এর পরিচর্যাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল এ বছরের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে। আমাদের আহ্বানে সারা দেশের বন্ধুরা গাছ রোপণে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন, তাতে বিগত বছরগুলোর চেয়ে বেশি গাছ রোপণ করা সম্ভব হয়েছে। এ জন্য বন্ধুদের ধন্যবাদ।’
সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন মল্লিক বলেন, প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পরিবেশ দূষণমুক্ত ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের পৃথিবী গড়তে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। বন্ধুরা সড়কের পাশে, পতিত জমিসহ তাঁদের শিক্ষাঙ্গনে বিভিন্ন প্রজাতির ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা রোপণ করার মধ্য দিয়ে পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।
প্রতিবছরের মতো এবারও নিজেরা বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি কুইজ ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে গাছ উপহার প্রদান, জনসাধারণকে উৎসাহী করতে ব্যতিক্রমী নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে বন্ধুরা। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে রাস্তার আইল্যান্ড, এতিমখানা, মসজিদ ও মাদ্রাসার প্রাঙ্গণেও গাছ রোপণ করেন বন্ধুরা। এবারও নিজেদের অর্থায়নে এবং কার্যকরভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করেছে, এমন ১০টি বন্ধুসভাকে সেরা হিসেবে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করবে জাতীয় পর্ষদ।