প্রযুক্তির বিপ্লবের এই যুগে আজকাল সবই স্মার্ট। সবকিছুই পাল্লা দিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ, স্মার্ট ব্যাগ পর্যন্ত বাজারে রয়েছে। তাহলে আপনার ঘরটিও স্মার্ট হবে না কেন? আধুনিক এই যুগে এখন সবকিছুই দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
আগেকার দিনের টেলিভিশনে চ্যানেল পরিবর্তন করতে হলে বিছানা থেকে উঠে টিভি সেটের সুইচ টিপতে হতো। সেই কাজটা সহজ করে দিয়েছে রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেম। এখন দূর থেকেই আপনি সেটিকে নিয়ন্রণ করতে পারেন৷ তাতে আপনার জীবন আরো আরামদায়ক হয়ে উঠছে, সময় বাঁচানো যাচ্ছে প্রচুর।
এভাবে ঘরের প্রতিটি যন্ত্রপাতি এমনকি দরজা-জানালা পর্যন্ত আপনি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন মোবাইল বা কোনো স্মার্ট ডিভাইসের সাহায্যে। যার ফলে আপনার ঘরটি হয়ে উঠবে স্মার্ট। এই সিস্টেমটিকেই বলা হয় স্মার্ট হোম অটোমেশন সিস্টেম।
স্মার্ট হোমের ধারণা
একটি স্মার্ট হোমের যেকোনো স্থানে বসে আপনি যেকোনো রুমের বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান, এসি ইত্যাদি আপনার মোবাইল ফোনের সাহায্যেই কন্ট্রোল করতে পারবেন। এর জন্য আপনার ফোনে প্রয়োজন হবে ইন্টারনেট কিংবা ওয়াইফাইজাতীয় কোনো ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের। ঘরের প্রত্যেকটি স্মার্ট ডিভাইস এমনকি ওয়াশিং মেশিন ও গিজার ইত্যাদিও এর আওতায় আসতে পারে। বিলাসিতার এই যুগে তাই বিলাসী জীবনযাপনের একটি অন্যতম অংশ হয়ে উঠেছে স্মার্ট হোম।
এছাড়া অধিকাংশ অটোমেশন সিস্টেমই এনার্জি সেভ করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, রাতে যেকোনো বাড়িতে বা বাড়ির বাইরে যেসব বাতি জ্বালানো হয় সেগুলো ভোরবেলায় উঠে নিভিয়ে দিতে হয়। যদি কোনোভাবে বাড়ির বাসিন্দারা দেরি করে ঘুম থেকে উঠে কিংবা বাতি নেভাতে ভুলে যায় তাহলে সেগুলো জ্বলতেই থাকে। ফলে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তির অপচয় হয়।
কিন্তু একটি স্মার্ট হোমে আপনি কন্ট্রোলিং অ্যাপ্লিকেশনের সাহায্যে প্রতিদিন নির্দিষ্টভাবে বাতি নেভানোর সময় সেট করে দিতে পারবেন, যার কারণে শক্তির অপচয় অনেক কমে যাবে৷ কিংবা অনেক স্মার্ট হোম সিস্টেমে অটোমেটেড সেন্সর থাকে যেগুলো সূর্যের আলোর উজ্জ্বলতা ডিটেক্ট করে বুঝতে পারে যে সকাল হয়েছে এবং বাতি নিভিয়ে দিতে হবে। এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতি নিভে যায়৷ এটি স্মার্ট হোম অটোমেশনের সাহায্যে এনার্জি সেভ করার একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র। যেকোনো ডিভাইসকেই অটোমেটেড সিস্টেমের আওতায় এনে সময় এবং শক্তি দুটোই সাশ্রয় করা যায়।
স্মার্ট হোমের সেবাসমূহ
আপনার ঘরকে স্মার্ট করে তুলতে সর্বপ্রথম আপনাকে একটি ইকোসিস্টেম বেছে নিতে হবে যার মাধ্যমে ঘরের সব স্মার্ট ও ইলেকট্রিক ডিভাইসগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকবে। বর্তমানে অনেকগুলো টেক জায়ান্টের নিজস্ব স্মার্ট হোম সার্ভিস রয়েছে। যেমন গুগলের গুগল নেস্ট, অ্যামাজন ইকো, অ্যাপলের হোমকিট ইত্যাদি। এই ইকোসিস্টেমগুলো যেমন ফোনের অ্যাপের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পাশাপাশি ইউজার এক্সপেরিয়েন্সকে আরো একধাপ উন্নত করতে ব্যবহার করা হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। এই প্রক্রিয়ায় আপনার ঘরে ছোট একটি বক্স আকৃতির ডিভাইস বসানো হয় যাতে থাকে মাইক্রোফোন ও স্পিকার। এর সাহায্যে আপনি ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন এবং সিস্টেমের কন্ট্রোলার এ আই আপনাকে একজন অ্যাসিস্টেন্টের মতোই কমান্ডের জবাব দেবে। অনেকটা আমাদের ফোনে থাকা গুগল অ্যাসিস্টেন্টের মতো। গুগল নেস্টের ক্ষেত্রে আপনার অ্যাসিস্টেন্ট হবে গুগল হোম।
একে সংক্ষিপ্তভাবে শুধু গুগল নামেও ডাকা যায়। অ্যামাজন তাদের সিস্টেমের এআইয়ের নাম দিয়েছে অ্যালেক্সা এবং অ্যাপলের ক্ষেত্রে তার নাম হলো সিরি। ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্টকে যেকোনো ভয়েস কমান্ড দেওয়ামাত্রই সে তা পালন করবে। আপনার নির্দেশমতো সব ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়াও বিনোদন দিতেও সাহায্য করবে এই অ্যাসিস্টেন্ট। তাদেরকে দিয়ে গান গাওয়ানো কিংবা কবিতা পাঠ করার মতো কাজও করানো যায়। ফলে আপনার একাকিত্বের সময়ে ভালো সঙ্গী হয়ে উঠতে পারে এই অ্যাসিস্টেন্ট।
স্মার্ট হোম সেটআপ
নিজের ঘরের জন্য একটি ইকোসিস্টেম বেছে নেওয়ার পর আপনি তাদের স্মার্ট হোম ডিভাইসটি আপনার ঘরে সেট করতে পারেন৷ প্রত্যেক স্মার্ট হোম সার্ভিসেরই একটি নিজস্ব অ্যাপ থাকে। সেই অ্যাপ ওপেন করে তাতে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ডিভাইসগুলোকে কানেক্ট করতে হয়।
স্মার্ট হোম অটোমেশনে আসতে হলে ডিভাইসগুলোকেও স্মার্ট হতে হয়। তবে বর্তমানে সাধারণ ডিভাইসগুলোকেও একটি অতিরিক্ত ডিভাইস ব্যবহার করার মাধ্যমে স্মার্ট ডিভাইসে পরিণত করা যায়। যেমন আপনার পুরনো দিনের টেলিভিশনকে অ্যান্ড্রয়েড টিভি বক্স ব্যবহার করে পরিণত করে ফেলতে পারেন স্মার্ট টিভিতে।
এমনকি আপনার রুমের দরজা কিংবা জানালায় স্মার্ট লক ইনস্টল করে দরজা-জানালাকেও স্মার্ট বানিয়ে ফেলতে পারেন। এর মাধ্যমে ভয়েস কমান্ড দিয়ে দরজা খোলা বা বন্ধও করা যাবে। বেশিরভাগ স্মার্ট ডিভাইসেই স্মার্ট হোম অটোমেশন সিস্টেমে কানেক্ট করার জন্য কিউআর কোড কিংবা সিরিয়াল নং দেওয়া থাকে। অ্যাপে সেই কোড স্ক্যান করে কিংবা নাম্বার এন্ট্রি করার মাধ্যমে আপনি ডিভাইসটিকে ইকোসিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসতে পারবেন।
একই জাতীয় একাধিক ডিভাইসের ক্ষেত্রে অ্যাপে সেগুলোর আলাদা আলাদা নাম কিংবা সিকুয়েন্স তৈরি করা যায়। যেমন একাধিক লাইটকে আপনি “light 1”, “light 2” -এভাবে নামকরণ করতে পারেন। অথবা আলাদা আলাদা রুমের লাইটগুলোকে “Drawing room light, Kitchen light” এভাবেও নাম দিতে পারবেন৷ বিভিন্ন ডিভাইসের জন্য ইউনিক ভয়েস কমান্ডও সেট করা যায়। এছাড়া অটোমেশন ডিভাইসের সাথে ইউজার ম্যানুয়াল দিয়ে দেওয়া হয়৷ সেখান থেকেও সম্পূর্ণ সেটআপ শিখে নেওয়া যায়।
স্মার্ট হোমের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ
এতদূর পর্যন্ত পড়ার পর স্মার্ট হোমের সুবিধাগুলো সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার ভালো ধারণা হয়ে গেছে। সময় আর শক্তি সাশ্রয় করা ছাড়াও বিনোদন পেতে, জীবনকে আরো আরামদায়ক করে তুলতে, এমনকি ঘরের নিরাপত্তা নজরদারি করতেও স্মার্ট হোম অটোমেশন অত্যন্ত সহায়ক।
বাড়ির বাইরে কোথাও গেলে আপনার বাড়ির সিকিউরিটি এলার্ম সিস্টেম আপনাকে ফোনে সতর্ক করতে পারে যদি বাড়িতে কোনো চোর প্রবেশের চেষ্টা করে। এছাড়া বাড়িতে লাগানো সিকিউরিটি ক্যামেরার সাহায্যে আপনি নিজেই নজর রাখতে পারেন বাড়ির উপর। এভাবে স্মার্ট হোম আপনার দৈনন্দিন জীবনযাপনকে এক অনন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে পারে।
স্মার্ট হোমের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এটি সেটআপ করতে যে যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় সেগুলো অনেকটাই খরচসাপেক্ষ৷ তাই সাধারণ মানুষ কিংবা অনেক মধ্যবিত্তদের পক্ষেও এই সেবা উপভোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া ঘরের পুরোনো কিংবা আনস্মার্ট ডিভাইসগুলোকে স্মার্ট ডিভাইসে পরিণত করতে কিছুটা ঝামেলা পোহাতে হয়৷
তবে আপনার কাছে যদি পর্যাপ্ত অর্থ থাকে এবং আপনি শৌখিন মানুষ হন, তাহলে আপনার জীবনকে আরো আনন্দময় করে তুলতে দারুণ ভূমিকা পালন করবে স্মার্ট হোম।
লেখক: মনির হোসেন।