২০০৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সদ্য অনার্স শেষ করা ইফতেখার হোসেন বিভোর ছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমানোর চিন্তায়। কিন্তু ব্যাংক মানি দেখাতে না পারায় তার সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
ইফতেখার হোসেন তার চাচা সাবেক আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর নির্মাণাধীন আগ্রাবাদের আক্তারুজ্জামান সেন্টার প্রকল্পে সাড়ে ৩ হাজার টাকা বেতনে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি নেন।
ইফতেখার ওই প্রকল্পের লিফট-জেনারেটর সম্পর্কিত বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। তার বাবার মালিকানাধীন আবুল হোসেন চৌধুরীর কনস্ট্রাকশন ফার্ম চৌধুরী অ্যাসোসিয়েট নির্মাণকাজটি করছিল।
ওই সময়ই ইফতেখার সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেই রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গড়বেন।
ইফতেখার বলেন, ‘তখন এই ইন্ডাস্ট্রির প্রধান সমস্যা ছিল মানুষের আস্থার অভাব। নির্ধারিত সময়ে পরেও অ্যাপার্টমেন্টের কাজ সম্পন্ন না করার অনিয়মই তখন প্রচলিত নিয়ম ছিল। আমি চিন্তা করলাম, এই ধারণা দূর করতে হবে।’
এই চিন্তা থেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চৌধুরী প্রোপার্টিজ ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (সিপিডিএল)।
তিনি জালানে, ‘আমাদের প্রথম প্রকল্প জামালখানের চৌধুরী হাইটস। ২৪ মাস মেয়াদি এই প্রকল্প আমরা ২২ মাসেই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।’
সিপিডিএলের প্রত্যেকটা প্রকল্পের সামনে টাইমার মেশিন বসানো হয় বলে জানালেন ইফতেখার। তিন বলেন, ‘আমরা প্রতিশ্রুত সময়ে অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করার সংস্কৃতি চালুর চেষ্টা করেছি।’
প্রায় দুই দশকে কোম্পানিটি ৩৩টি প্রকল্প হস্তান্তর হয়েছে। সেইসঙ্গে সিপিডিএলের হাত ধরে ফুল ফার্নিশড স্টুডিও অফিস অ্যাপার্টমেন্ট, সেকেন্ড হোমের মতো সৃজনশীল ধারণায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ হয়েছে। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রামে ২৩টি প্রকল্পের কাজ চলছে।
চট্টগ্রামে কনডোমিনিয়ামের ধারণা পরিচিত করিয়েছে সিপিডিএল। এক ছাদের নিচে বসবাসের আনুষঙ্গিক সব সুবিধাই কনডোমিনিয়াম। এসব অ্যাপার্টমেন্টে সুইমিং পুল, ওয়াকওয়ে, জিমনেশিয়াম, ব্যাডমিন্টন কোর্ট, লাউঞ্জ, বাচ্চাদের খেলার স্থানসহ প্রয়োজনীয় সব আধুনিক সুবিধা থাকে।
চট্টগ্রামে আধুনিক লাইফস্টাইলের সুবিধা-সংবলিত প্রথম এ ধরনের অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করেছে সিপিডিএল। নগরীর মেহেদীবাগ এলাকায় ৩০ কাঠা জমিতে ক্রিমসন ক্লোভার নামে প্রকল্পটি সম্পন্ন করা হয় ২০১৪ সালে। একে বলা হয় চট্টগ্রামের প্রথম স্টার ক্লাস রেসিডেন্স।
প্রতিষ্ঠানটি সবসময় সৃজনশীল ও নতুন নতুন ধারণা নিয়ে কাজ করছে। কনডোমিনিয়ামের আদলে মধ্যব্ত্তিদের জন্য নগরীর ফিরিঙ্গিবাজারে ৬০ কাঠা জমিতে ডাউন-টাউন নামে প্রকল্প করেছে সিপিডিএল।
নগরীতে প্লাজা ডে সিপিডিএল নামে ফুল ফার্নিশড স্টুডিও অফিস অ্যাপার্টমেন্টও নির্মাণ করেছে সিপিডিএল। সাধারণত ১০টি অফিসের জন্য আলাদা ১০টি ওয়েটিং রুম, কিচেনসহ সবকিছুর প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্লাজা ডে সিপিডিএলে সবার জন্য কমন ফ্যাসিলিটি রয়েছে। এতে করে অফিস খরচ কমছে। অল্প জায়গা ব্যবহার করে বেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করতে পারছে।
নগরীর ফয়েজ লেক এলাকায় ২০ কাঠা জমিতে দ্য গ্যালারিও নামে সেকেন্ড হোম কনসেপ্টে অ্যাপার্টমেন্ট করছে সিপিডিএল। ১৮ তলা ওই ভবনে ছোট ছোট ১০০টি ইউনিট করা হচ্ছে।
ব্যবসায়িকসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসেন অনেকে। তাদের জন্য এই প্রকল্প। ৩৭৫-৯৭৫ বর্গফুটের এসব ছোট ছোট ইউনিটে বছরের কিছু সময় নিজেরা থাকার পাশাপাশি হোটেল/হোস্টেলের মতো করে ভাড়াও দিতে পারবেন ফ্ল্যাট মালিকরা।
সিপিডিএলের প্রেসিডেন্ট ইফতেখার হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘আমরা সবসময় একটু ভিন্নভাবে চিন্তার চেষ্টা করেছি। নতুনত্ব আনতে চেয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামের জামালখান এখন মুক্ত বাতাসে বসার মতো জায়গায় পরিণত হয়েছে। এটিও সিপিডিএলের হাত ধরে শুরু। ঢাকা বেইলি রোডের আদলে আমরা শুরু করেছিলাম।
‘চকবাজারের দেবপাহাড় এলাকায় আমরা যখন প্রকল্প করতে যাই, তখন অনেকে বলেছিলেন, এখানে কে আসবে! “সবুজ ঐতিহ্যে অনন্য দেবপাহাড়” স্লোগানে ওই এলাকার পরিবেশ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। এগুলোকে আমরা বলি সোশ্যাল হ্যাপিনেস। সবসময় আর্থিক লাভ হিসেবে নিয়ে কাজ করা যায় না।’
ইফতেখার বলেন, ‘আমাদের এমন কিছু অতিথি চলে আসে, যাদের বাসায় নেওয়া যায় না। তাদের জন্য কনডোনিয়ামে কমন লাউঞ্জ-ড্রইং রুম রয়েছে। সেখানে একটি ফুডকোর্টও আছে। একেবারে নিজের বাসার ড্রইং রুমের মতো।’
প্রকল্প হস্তান্তরের পর সব দায়িত্ব শেষ করে না কোম্পানিটি। গ্রাহকদের কমিউনিটি গঠন করে নিয়মিত সুবিধা-অসুবিধার দেখভাল করে তারা।
প্রকল্প হস্তান্তরের পর সেবা দেওয়ার জন্য সিপিডিএল সার্ভিস অ্যাপ বানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সেখানে সমস্যার কথা জানালে ঘরে সেবা পৌঁছে যায়।
ইফতেখার হোসেন বলেন, ‘কাজ শেষ করে আমরা চলে যাই না। অ্যাপার্টমেন্টের সবকিছু কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, তা নিয়েও নিয়মিত মতবিনিময় করা হয়। আমরা শুধু আর্থিক লাভের জন্য কাজ করছি না। ১০০ বছর পরও যেন মানুষ সিপিডিএলকে মনে রাখে, সে লক্ষ্যে কাজ করছি।’
সিপিডিএল প্রতিষ্ঠার পর সময়ের প্রয়োজনে আরো সাতটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন ইফতেখার হোসেন।
কর্ণফুলীর ওপারে হচ্ছে স্যাটেলাইট সিটি
চলতি বছর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল চালু হলে নদীর দুই পারের যোগাযোগ সহজ হবে। শহরের বাইরেও কিছু মানুষ বসবাস করতে চান। কিন্তু আধুনিক সুযোগ-সুবিধার অভাবে তারা যান না।
কর্ণফুলীর তীরবর্তী আনোয়ারা উপজেলায় স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে সিপিডিএল। সেখানে ৬ একর জমিতে অনিন্দনগর নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইফতেখার হোসেন বলেন, ‘শহরের বাইরে আনোয়ারা একটি গ্রোথ সেন্টার। ওয়ান সিটি টু টাউনের সুবিধায় সেখানে স্যাটেলাইট সিটি গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে। স্কুল, কলেজ, পার্ক, ধর্মীয় উপসানালয়সহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে মানুষ সেখানেও বসবাস করবে।
‘আমরা ধীরে ধীরে কাজ করছি। আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যোগাযোগ করছি শিক্ষার মান বাড়াতে। স্যাটেলাইট সিটি গড়ার লক্ষ্যে সিপিডিএল নীড় নামে আলাদা কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।’
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিসহ সংকটের মধ্যে যাচ্ছে রিয়েল এস্টেট এবং নির্মাণ শিল্প। কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করছে সিপিডিএল—এমন প্রশ্নের উত্তরে ইফতেখার বলেন, ‘এসব চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি সামলানোই ব্যবসায়ীর কাজ। ব্যবসা করতে গেলে নানা ধরনের পরিস্থিতি সামনে আসবে। এর মধ্যে স্ট্রাকচারাল প্রতিষ্ঠান কৌশল দিয়ে টিকে থাকবে। আমরা প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।’