বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার উত্তেজনা বেড়েই চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে চীনা বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে অন্য দেশে বিস্তৃতি বাড়ানোয় মনোযোগী হয়েছে বহুজাতিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো।
এক্ষেত্রে সস্তা শ্রমিক ও স্থিতিশীল বাজারের কারণে ভালো বিকল্প হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে বেছে নিচ্ছে তারা।
চীনের বাইরে উৎপাদন কাঠামো বিস্তারের এ কৌশল ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। দক্ষিণ এশীয় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠান মঙ্ক’স হিল ভেঞ্চারের সহপ্রতিষ্ঠাতা কু-উয়ি লিম বলেন, ‘চায়না প্লাস ওয়ান কার্যক্রম শুরু হয়েছিল কভিড-১৯ মহামারীর সময়ে। ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে এ কার্যক্রম আরো জোরদার হয়েছে।’
চায়না প্লাস ওয়ান কৌশলে মূলত চীনা বাজারে উপস্থিতি ধরে রাখার সঙ্গে সঙ্গে অন্য দেশের বাজারে ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের কথা বলা হয়। এর উদ্দেশ্য চীনা বাজার কিংবা সাপ্লাই চেইনের ওপর নিরঙ্কুশ নির্ভরশীলতা কমানো, যাতে ব্যবসায়িক ঝুঁকি কমিয়ে আনা যায়।
চায়না প্লাস ওয়ানের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আশিয়ান ব্লকে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে।
ওভারসিজ-চাইনিজ ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেডের (ওসিবিসি) অর্থনীতিবিদরা মে মাসের প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, আশিয়ানভুক্ত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ২০২৩ সালে ২৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। ২০২০ ও ২০২২ সালের মধ্যে এসব দেশে গড় বিদেশী বিনিয়োগ ছিল ১৯ হাজার কোটি ডলার। এসব বিনিয়োগ প্রধানত যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীনের মূল ভূখণ্ড ও হংকং থেকে এসেছে।
ওসিবিসির অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আশিয়ান অঞ্চল বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সাপ্লাই চেইনে বৈচিত্র্য বৃদ্ধি এবং চায়না প্লাস ওয়ান কৌশলের উপকারভোগী হচ্ছে। চীনের মূল ভূখণ্ড ও হংকং থেকে বিদেশী বিনিয়োগ আসায় এ অঞ্চলের শিল্প ও অন্যান্য সেবা খাতে নতুন গতি সঞ্চার হয়েছে।
কভিড-১৯ মহামারীকালে কড়াকড়ি ও ফিক্সকনের ফ্ল্যাগশিপ আইফোন উৎপাদন কেন্দ্রে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে চীনে অ্যাপলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে চায়না প্লাস ওয়ান কৌশলের অংশ হিসেবে ভিয়েতনামকে উৎপাদনের জন্য বেছে নিয়েছে কোম্পানিটি।
ইনসিগমিয়া ভেঞ্চারস পার্টনারের প্রতিষ্ঠাতা ম্যানেজিং পার্টনার ইংলান তান বলেন, ‘চীনের কাছাকাছি হওয়ায় ভিয়েতনাম থেকে বিদেশে পণ্য পাঠানো সহজ। ফলে উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে কমানো সম্ভব হচ্ছে। অ্যাপল ছাড়াও দেশটি এরই মধ্যে স্যামসাং স্মার্টফোনের গবেষণা, উৎপাদন ও রফতানির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
এ মাসের শুরুতে বিঅফএ সিকিউরিটিজের আশিয়ান অর্থনীতিবিদ কাই ওয়ে আং বলেন, ‘সাশ্রয়ী শ্রমবাজারের কারণে ভিয়েতনামের বাজার আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তাছাড়া দেশটির শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধার কারণেও সেখান থেকে রফতানি করা অধিক লাভজনক।’
এদিকে ইন্টেল ও ইনফিনিয়নসহ সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রির বড় প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে মালয়েশিয়ায় তাদের উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন বা সম্প্রসারণ করছে। দেশটিতে সেমিকন্ডাক্টর ছাড়াও সোলার প্যানেল ও বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির (ইভি) যন্ত্রাংশ তৈরির আগ্রহ রয়েছে বিনিয়োগকারীদের।
এদিকে ইন্দোনেশিয়ায় ইভি উৎপাদন হাব নির্মাণের লক্ষ্যে চলতি মাসে চীনা চারটি কোম্পানি-নেতা, উলিং, চেরি ও সকনের সঙ্গে চুক্তি করেছে দেশটির শিল্প মন্ত্রণালয়। আসিয়ানের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেও সিঙ্গাপুরকে অন্যতম স্থিতিশীল অর্থনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে এ অঞ্চলে ব্যবসা সম্প্রসারণে সিঙ্গাপুর সবচেয়ে বেশি আকাঙ্ক্ষিত স্থান।
ইংলান তান বলছেন, উদ্যোক্তারা সিঙ্গাপুরে তাদের আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছেন। কেননা এখানে বসে যেমন যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজি সঞ্চালন করা যায়, তেমনি চীনেও উৎপাদন চালানো সম্ভব হয়। ফলে শুধু অ্যাপলের মতো বড় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং ছোট ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোও দেশটি নিয়ে পরিকল্পনা করছে। সূত্র: সিএনবিসি।