স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দেওয়ায় সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের উন্নয়নকাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে রড-সিমেন্টের বিক্রি কমেছে।
ইনফোগ্রাফিক: টিবিএস
গত দুবছর ধরে মন্থর চাহিদা ছিল দেশের ইস্পাত ও সিমেন্ট শিল্পে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্তিমিত হয়ে পড়ায় এখন আরও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে এ খাত।
শিল্পসূত্রে জানা গেছে, গত দুমাসে কোম্পানিভেদে রডের বিক্রি ৫০–৭০ শতাংশ এবং সিমেন্টের বিক্রি ৩৫–৪০ শতাংশ কমেছে।
সূত্র জানায়, চাহিদা কমে যাওয়ায় গত দুমাসে হালকা স্টিলের রডের দাম টনপ্রতি ছয় থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে।
এর ফলে কারখানায় পণ্য মজুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নতুন উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। শিল্প মালিকেরা জানিয়েছেন, কাজ না থাকা সত্ত্বেও তারা শ্রমিকদের বেতন প্রদান অব্যাহত রেখেছেন।
শিল্প নেতারা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে এবং সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো পুনরায় শুরু না হলে ইস্পাত এবং সিমেন্ট খাত দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
চাহিদা ও বিক্রিতে বড় পতন
চট্টগ্রাম-ভিত্তিক এইচএম স্টিল সাধারণত স্বাভাবিক অবস্থায় দৈনিক ৬০০–৭০০ টন এমএস রড উৎপাদন করে। তবে চাহিদা ও বিক্রি কমে যাওয়ায় সম্প্রতি এটির উৎপাদন নেমে এসেছে ২৫০–৩০০ টনে।
এইচএম স্টিলের পরিচালক সারওয়ার আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা উৎপাদন খরচের তুলনায় দুই থেকে তিন হাজার টাকা কম দামে রড বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে ক্ষতি কমাতে কারখানাটি ৫০–৬০ শতাংশ উৎপাদন হ্রাস করেছে।
তিনি আরও জানান, তাদের আরেকটি কারখানা গোল্ডেন স্টিলও দৈনিক উৎপাদন কমিয়ে ১৫০–২০০ টনে নামিয়ে এনেছে, যা স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল ৪০০–৫০০ টন।
বাজারের শীর্ষ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ মন্দা থেকে বাদ পড়ছে না। দেশের অন্যতম প্রধান রড উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম-ও বাজারের সাম্প্রতিক পতনে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত হয়েছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার পরিবর্তনের পর বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ স্তিমিত হয়ে পড়েছে। নির্মাণকাজের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারদের অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দেওয়ায় সিটি করপোরেশন থেকে শুরু করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের উন্নয়নকাজেও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে রড-সিমেন্টের বিক্রি কমেছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বিএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর সরকারি ও বেসরকারি নির্মাণ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে এবং নতুন কোনো প্রকল্প শুরু হয়নি।
‘ফলে গত দুমাসে ইস্পাতের বাজারে বড় দরপতন হয়েছে। এ সময়ে ইস্পাতের চাহিদা ও বিক্রি ৫০ শতাংশ কমে গেছে। লোকসান কমাতে আমাদের উৎপাদন কমিয়ে আনতে হয়েছে,’ তিনি বলেন।
উৎপাদন বন্ধ-কাটছাঁট
চাহিদা ও বিক্রি কমে ক্রমাগত লোকসান হওয়ায় চট্টগ্রামভিত্তিক আরেকটি ইস্পাত প্রস্তুতকারক কেআর স্টিল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
কেআর গ্রুপের চেয়ারম্যান সেকান্দার হোসেন টিবিএসকে জানান, ‘রডের বাজারমূল্য উৎপাদন খরচের চেয়ে কমে যাওয়ায় আমরা ২২ আগস্ট কারখানার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, কেআর স্টিলের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা সাধারণত ২৫০ থেকে ২৭০ টন।
ঘোড়াশালে অবস্থিত এমএস রড কারখানাসহ পিএইচপি গ্রুপের একাধিক কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়েছে বলে জানান গ্রুপটির একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক কারখানার মালিক ক্ষতি কমাতে তিন শিফটের পরিবর্তে দুই শিফটে কারখানা পরিচালনা করছেন এবং সপ্তাহে একদিনের বদলে দু’দিন কারখানা বন্ধ রাখছেন।
রড প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ীদের মতে, বর্তমানে ৭৫-গ্রেড (অটোমেটিক) এমএস রড কারখানা পর্যায়ে প্রতি টন ৮৬–৮৮ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা দুমাস আগে ৯২–৯৪ হাজার টাকা ছিল।
একইভাবে, ৬০-গ্রেড (সেমি-অটো) রডের দাম দুই মাস আগের প্রতি টন ৮৬–৮৮ হাজার টাকা থেকে এখন প্রতি টন ৭৮–৮১ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।
কেএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান জানান, প্রতি টন রডে বর্তমানে তারা ২৪ হাজার টাকা লোকসান করছেন। এক টন রড উৎপাদনে তাদের খরচ এক লাখ ১০ হাজার থেকে এক লাখ ১২ হাজার টাকা, অথচ তারা এটি বিক্রি করছেন মাত্র ৮৬ হাজার টাকায়।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) অনুসারে, দেশে প্রায় ২০০টি ইস্পাত কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৪০টি বড় কোম্পানি। এ খাতের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১.১০ কোটি টন রড, যেখানে দেশের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭৫ লাখ টন। এ খাতে মোট বিনিয়োগ প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
কাঁচামালের দাম উর্ধ্বমুখী
এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে উদ্যোক্তারা লোকসান আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন।
তাহের গ্রুপের পরিচালক দিদারুল আলম জানান, চাহিদা কমে যাওয়ায় গত দুমাসে দেশীয় বাজারে স্ক্র্যাপের দাম ৫৮ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাবে গত তিনদিনে স্ক্র্যাপের দাম তিন হাজার টাকা বেড়ে বর্তমানে ৫৩ হাজার টাকায় পৌঁছেছে বলে তিনি জানান।
একইভাবে, বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির কারণে পেলেটের দাম ৭৮ হাজার টাকা থেকে ৭০ হাজার টাকায় নেমে এখন প্রতি টন ৭২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চাপে সিমেন্ট খাত
দেশে সিমেন্ট উৎপাদনকারী শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি প্রিমিয়ার সিমেন্ট রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা সেতু এবং কর্ণফুলী টানেলসহ সব বড় মেগা প্রকল্পের জন্য সিমেন্ট সরবরাহ করেছে।
তবে, কোম্পানির সিমেন্ট বিক্রি গত প্রান্তিকে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) আগের প্রান্তিকের (মার্চ–জুন) তুলনায় ২৫–৩৫ শতাংশ কমেছে।
প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক টিবিএসকে জানান, মূলত দুটি কারণে বিক্রি কমেছে। প্রথমত, বেশ কিছু বড় অবকাঠামো প্রকল্প থমকে গেছে। দ্বিতীয়ত, সিটি কর্পোরেশন থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্বশূন্যতার কারণে নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
এর ফলে সিমেন্ট ব্যবসায় প্রবৃদ্ধির পরিবর্তে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। তিনি অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলো দ্রুত পুনরায় শুরু করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে বাজারে প্রতি বস্তা সিমেন্ট ৪৬৫ থেকে ৪৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রামের পাইকারি সিমেন্ট ব্যবসায়ী এবং মেসার্স আইজা এন্টারপ্রাইজের মালিক এস এম আরিফুজ্জামান জানান, সাধারণত প্রতিদিন গড়ে ১০–১৫ হাজার বস্তা সিমেন্ট বিক্রি হয়। তবে গত দুমাসে বিক্রি এতটাই কমেছে যে এখন প্রতিদিন গড়ে মাত্র ২৫০–৩০০ বস্তা বিক্রি হচ্ছে।
আরেকটি বড় উৎপাদক রয়্যাল সিমেন্ট সাধারণত প্রতিদিন গড়ে ৫০–৬০ হাজার বস্তা সিমেন্ট বিক্রি করত। কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক আবুল মনসুর জানান, গত দুমাসে বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের কারখানার প্রতিদিন ৯৬ হাজার বস্তা সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে গড় উৎপাদন ছিল ৫০–৭০ হাজার বস্তা। তবে, চাহিদার অভাবে আমাদের উৎপাদন কমিয়ে ২০–৩০ হাজার বস্তা করতে হয়েছে।’
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে ৪০টি সিমেন্ট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি একই গ্রুপের অধীনে পরিচালিত। দেশের বার্ষিক প্রায় চার কোটি টন চাহিদার বিপরীতে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় সাত কোটি আট লাখ কোটি টন।