চলমান দুটি বৃহৎ সংঘাত, সমুদ্রপথে অনিশ্চয়তা ও দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সারা বিশ্বের বাণিজ্যকে বড় আকারে প্রভাবিত করছে। সাম্প্রতিক এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ভারত রফতানি লক্ষ্যমাত্রা ৮০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী মন্ত্রণালয়।
মুম্বাইয়ে এক অনুষ্ঠানে গত শনিবার বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গয়াল জানান, চলতি অর্থবছরে ভারতের পণ্য ও পরিষেবা রফতানি ৮০ হাজার কোটি ডলার অতিক্রম করতে পারে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩ শতাংশ বেশি।
মার্চে শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৭ হাজার ৮২০ কোটি ডলারের পণ্য ও পরিষেবা রফতানি করে ভারত, যা এখন পর্যন্ত দেশটির রফতানি আয়ে একটি রেকর্ড। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছর ৭৭ হাজার ৬৪০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করে ভারত।
ক্রমাগত ‘ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বাড়ছে’ উল্লেখ করে পীযূষ গয়াল জানান, দুটি চলমান সংঘাত, লোহিত সাগরের সংকট এবং চলতি বছর ও পরের বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সব মিলিয়ে বিশ্বব্যাপী গুরুতর পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
জেমস অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিল আয়োজিত অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আত্মবিশ্বাসী যে চলতি অর্থবছরে পণ্য ও পরিষেবা উভয় খাতেই রফতানি বাড়বে। এতে আমরা ৮০ হাজার কোটি রফতানির রেকর্ড তৈরি করব।’
পীযূষ গয়াল জানান, অর্থবছরের শুরুতে রফতানিতে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। মে মাসে ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় ভারতীয় পণ্যের রফতানি বেড়েছে ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। একে তিনি চলতি অর্থবছরের জন্য ‘একটি ভালো সংকেত’ বলে উল্লেখ করেন।
এরই মধ্যে বিভিন্ন খাতে সংশ্লিষ্ট ভারতীয় মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে কাজ শুরু করেছে। এর সঙ্গে প্রমোশন কাউন্সিল ও বিদেশে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসগুলো যুক্ত রয়েছে বলে জানান এ মন্ত্রী।
ভারতীয় এ মন্ত্রীর দাবি অনুসারে, বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য যখন কমছে তখন ভারত রফতানিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির পরিবর্তনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন তিনি। ফলে কিছু পণ্য আগের চেয়ে কম আমদানি করতে হচ্ছে। বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত গাড়ির স্থলে ইভির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় চলতি বছর ভারতে জ্বালানি তেলের আমদানি হ্রাস পাবে।
কিছু রফতানি পণ্যের নাম উল্লেখ করে পীযূষ গয়াল বলেন, ‘রাবার, চা, মসলা ও কফির মতো উদ্ভিজ্জ পণ্যের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। এসব পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি, মূল্য সংযোজন ও গুণমানের উন্নয়ন আমাদের লক্ষ্য।’
বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর আগ্রহ লক্ষণীয়। দেশটি একাধিক দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত। চলতি বছরে রফতানি সম্প্রাসরণে এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত। এরই মধ্যে একাধিক দেশ ও ফোরামের সঙ্গে যোগাযোগও করেছে। মুম্বাইয়ের অনুষ্ঠানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে প্রস্তাবিত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পর্কে জানান পীযূষ গয়াল।
ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা চুক্তির অষ্টম দফা আলোচনার জন্য সম্প্রতি ব্রাসেলস সফর করেছেন। এ বিষয়ে বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী বলেন, ‘ইইউর সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী। এতে আমরা দ্রুত অগ্রগতি আশা করছি।’
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এফটিএ আলোচনার অগ্রগতির বিষয়েও আস্থা প্রকাশ করেছেন পীযূষ গয়াল। সম্প্রতি দেশটির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভারতীয় পক্ষের আলোচনা হয়েছে। তবে ৪ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য যুক্তরাজ্যের জাতীয় নির্বাচনের ওপর অনেককিছু নির্ভর করছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ান হীরা আমদানির ওপর পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জি৭ জোট। মন্ত্রী জানান, নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাই পরোক্ষ এ নিষেধাজ্ঞা ভারতের রফতানিকে প্রভাবিত করবে না।
বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ কাটা হীরা ও পলিশিং ব্যবসার উৎস ভারত। এ খাতে দেশটির প্রধান রফতানি বাজার হলো জি৭-ভুক্ত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান ও কানাডা।
এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রফতানিতে রেকর্ড করলেও চীন, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও কোরিয়াসহ শীর্ষ ১০টি বাণিজ্য অংশীদারের মধ্যে নয়টির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতির রেকর্ড করেছিল ভারত। ওই সময় চীন, রাশিয়া, কোরিয়া ও হংকংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে।
গত অর্থবছরে ভারতের মোট বাণিজ্য ঘাটতি ২৩ হাজার ৮৩০ কোটি ডলারে সংকুচিত হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ২৬ হাজার ৪৯০ কোটি ডলার। চলতি বছরের ঘাটতি আরো কমিয়ে আনার দিকে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
গত মে মাসের বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রকাশ হলে অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) জানায়, যদি না একটি দেশ অন্য দেশের সরবরাহের ওপর গুরুতরভাবে নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে, তবে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি বড় কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। সূত্র: ইকোনমিকস টাইমস।