দেশে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে অন্যতম শীর্ষস্থানে সঞ্চয়পত্র। অনেক নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকায় পরিবারের খরচ চালান। বর্তমানে সঞ্চয়পত্র কেনা ও মুনাফা উত্তোলনের ব্যবস্থা ডিজিটাল হয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের ৭১টি সঞ্চয় ব্যুরো কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সব কার্যালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, ডাকঘর ছাড়াও বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সঞ্চয়পত্র কেনা ও ভাঙানো যায়।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের চালু সঞ্চয় কর্মসূচির (স্কিম) সংখ্যা ১১। এগুলোর মধ্যে ৪টি সঞ্চয়পত্র, ২টি ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক হিসাব, ১টি ডাক জীবনবিমা, ১টি প্রাইজবন্ড এবং ৩টি প্রবাসীদের জন্য বন্ড। সব কর্মসূচিতে বিনিয়োগের বিপরীতে সুদ বা মুনাফার হার ভিন্ন। সুদ বা মুনাফার ওপর উৎসে কর কর্তনের হারও ভিন্ন।
কোন সঞ্চয়পত্রে কত মুনাফা
১৯৭৭ সালে প্রথম পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র প্রবর্তন করে সরকার। পরে আরও তিনটি-তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পেনশনার সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্র প্রবর্তন করা হয়। চার ধরনের সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি সুদ পেনশনার সঞ্চয়পত্রে। এ হার ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
তবে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তান এতে বিনিয়োগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে অর্জিত সুদের ওপর কোনো উৎসে কর নেই। তার বেশি বিনিয়োগের সুদের বিপরীতে উৎসে কর ১০ শতাংশ।
পেনশনার সঞ্চয়পত্রের পর বেশি সুদ পরিবার সঞ্চয়পত্রে। এ ক্ষেত্রে সুদের হার ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে। তবে বছরভিত্তিক সুদ ভাগ ভিন্ন হয়। যেমন প্রথম বছর শেষে সাড়ে ৯, দ্বিতীয় বছর শেষে ১০, তৃতীয় বছর শেষে সাড়ে ১০ এবং চতুর্থ বছর শেষে ১১ শতাংশ। উৎসে কর ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে সুদের ওপর ৫ শতাংশ। তার বেশি বিনিয়োগের সুদের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ। ১৮ বা তার বেশি বয়সের বাংলাদেশি নারী, যেকোনো বয়সের শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী-পুরুষ এবং ৬৫ বা তার বেশি বয়সের নারী-পুরুষ পরিবার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। যৌথ নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষ পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারেন। একক নামে ৩০ লাখ অথবা যুগ্ম নামে ৬০ লাখ টাকা এসব সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা যায়। প্রতিষ্ঠান আরও বেশি বিনিয়োগ করতে পারে।
পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে সুদ ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙালে সুদ প্রথম বছর শেষে ৯ দশমিক ৩৫, দ্বিতীয় বছর শেষে ৯ দশমিক ৮০, তৃতীয় বছর শেষে ১০ দশমিক ২৫ এবং চতুর্থ বছর শেষে ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ সঞ্চয়পত্রেও ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ। ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদের ওপর উৎসে কর ১০ শতাংশ।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এটির মেয়াদ তিন বছর। তার আগেও নগদায়ন করা যায়। সে ক্ষেত্রে সুদের হার কমে যাবে। তিন বছর শেষে সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ হলেও দুই বছর শেষে সাড়ে ১০ শতাংশ এবং এক বছর শেষে ১০ শতাংশ। ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগে উৎসে কর ৫ শতাংশ, তার বেশি বিনিয়োগ গুনতে হবে ১০ শতাংশ উৎসে কর।
প্রবাসীদের জন্য আছে বন্ড
প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য তিন ধরনের বন্ড রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ১২ শতাংশ সুদ ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে। এটি পাঁচ বছর মেয়াদি। ৬ মাস অন্তর সুদ তোলার সুযোগ রয়েছে। ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড তিন বছর মেয়াদি। এর সুদের হার সাড়ে ৬ শতাংশ। প্রবাসীদের জন্য আরেকটি বন্ড রয়েছে, যার নাম ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড। তিন বছর মেয়াদি এই বন্ডে সুদের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তিনটিরই বিনিয়োগের বিপরীতে পাওয়া সুদ করমুক্ত।
ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাকি দুই বন্ডে অবশ্য কোনো সীমা নেই। অর্থাৎ যত খুশি অর্থ বিনিয়োগ করতে পারবেন প্রবাসীরা। এসব বন্ড দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের এডি শাখা, বিদেশে থাকা বাংলাদেশের ব্যাংকের শাখা, এক্সচেঞ্জ হাউস ও এক্সচেঞ্জ কোম্পানি থেকে কেনা যায়।
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে দুই হিসাব
ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের আওতায় দুটি কর্মসূচি আছে। একটি সাধারণ হিসাব, অন্যটি মেয়াদি হিসাব। দেশের সব শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি নাগরিকই কর্মসূচি দুটিতে বিনিয়োগ করতে পারেন।
সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদ সরল হারে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর মেয়াদি হিসাবের সুদ হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মেয়াদি হিসাবটি তিন বছরের জন্য। তিন বছরের মেয়াদ পূর্তির আগে ভাঙানোর ক্ষেত্রে এক বছরের জন্য সুদ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ।
আর দুই বছরের জন্য ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ। এ দুটির ক্ষেত্রেও ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে পাওয়া সুদের ওপর উৎসে কর ৫ শতাংশ, এর বেশি বিনিয়োগের সুদের ওপর ১০ শতাংশ। দুটি কর্মসূচিতে একক নামে ১০ লাখ ও যুগ্ম নামে ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগের সুযোগ আছে।
ডাক জীবনবিমায় পলিসি দুই ধরনের, আজীবন ও মেয়াদি। যেকোনো নাগরিক যেকোনো ডাকঘরে গিয়ে ডাক জীবনবিমা পলিসি নিতে পারেন। পলিসির কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই। আজীবন বিমার ক্ষেত্রে প্রতি হাজারে প্রতিবছরে বোনাস পাওয়া যায় ৪২ টাকা। আর মেয়াদি বিমার ক্ষেত্রে বছরে প্রতি হাজারে বোনাস ৩৩ টাকা। এই বোনাস করমুক্ত।