তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে সিরামিক শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পণ্য উৎপাদনে এ শিল্পে গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই প্রয়োজন হয়। কিন্তু গত এক মাস যা ২-৩ পিএসআইতে নেমে যাচ্ছে। কখনো কখনো একেবারেই থাকছে না গ্যাস।
অথচ গ্যাসনির্ভর এ প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিতে পণ্য উৎপাদন করতে কিলন বা চুল্লিতে ২৪ ঘণ্টাই নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহের প্রয়োজন। সংকট নিরসনে বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে (বিসিএমইএ) সরকারকে দেয়া এক চিঠি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিসিএমইএ চিঠিতে জানায়, গত প্রায় এক মাস ঢাকার মিরপুর-১২, সাভার, ধামরাই, গাজীপুরের টঙ্গী, কাশিমপুর, ভাবানীপুর, ভাওয়াল মির্জাপুর, শ্রীপুর, মাওনা, নরসিংদীর পাঁচদোনা এবং ময়মনসিংহের ভালুকা ও ত্রিশাল এলাকায় অবস্থিত ২২ থেকে ২৫টি সিরামিক তৈজসপত্র, টাইলস, স্যানিটারিওয়্যার ও সিরামিক ব্রিকস কারখানায় তীব্র গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যেখানে ১৫ পিএআই প্রেসার প্রয়োজন সেখানে গ্যাসের প্রেসার কখনো কখনো ২-৩ পিএসআই থেকে শূন্যের কোঠায় নেমে আসছে। এতে করে প্রতিদিন ওই সব এলাকায় উৎপাদন ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকা।
রূপগঞ্জ ও নরসিংদীতে বিসিএমইএর প্রেসিডেন্ট মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লার দুটি কারখানা রয়েছে। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ খাতে ৭০টির মতো কারখানা রয়েছে। আমার দুটি কারখানাসহ এক-তৃতীয়াংশই বন্ধ। এর বাইরে কিছু আছে থেমে থেমে চলছে।’
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা গ্যাসের পুরো টাকাই পরিশোধ করি। সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে সেটিও তো রক্ষা হচ্ছে না। সরকারকে চিঠি দিয়েছি, এখন গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কারণ একবার চুল্লি বন্ধ করলে সেটি চালু করতে দু-তিনদিন সময় লাগে।’
বিসিএমইএর প্রেসিডেন্ট জানান, গ্যাসের চাপ অনুমোদিত হার থেকে কমে গেলে সিরামিক পণ্য নষ্ট হয়ে যায়, মানও খারাপ হয়। তখন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হয়। বিদেশী কোম্পানিগুলো অর্ডার বাতিল করে দেয়।
বিসিএমইএর তথ্যমতে, সিরামিক খাতে দেশী-বিদেশী মোট বিনিয়োগ প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশই এখানে উৎপাদিত হয়। টাকার অংকে যার পরিমাণ ৮ হাজার কোটি টাকা। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকারও বেশি এবং গ্যাস বিল বাবদ উৎপাদকরা পরিশোধ করেন ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। গত ১০ বছরে ২০০ শতাংশ বিস্তৃতি লাভ করা সিরামিক খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার মধ্যে নারীকর্মী ২০ শতাংশ।
এছাড়া সিরামিক পণ্যে ভ্যালু অ্যাডিশন ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ৫০টিরও অধিক দেশে সিরামিক পণ্য রফতানি করা হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সিরামিক পণ্য রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। কিন্তু রফতানি হয়েছে ৩ কোটি ৩ লাখ ৪০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩০ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল প্রায় ৪ কোটি ডলারের পণ্য। দুই অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি কমেছে সাড়ে ৯ কোটি ডলারের বেশি, যা প্রায় ২৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গ্যাস সংকট নিরসন না হলে রফতানি প্রবৃদ্ধি আরো অনেক কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন উৎপাদকরা।
সিরামিক পণ্যের উৎপাদক মার্কো পলো গ্রুপের পরিচালক আজিজুল হাকিম সুমন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা দুটি কারখানায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। গ্যাস সংকটের কারণে জেনারেটর দিয়ে ক্লিন চালু রাখছি, যাতে পরবর্তী সময়ে গ্যাস এলে কারখানা চালু করা যায়। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে অনেক। সেই সঙ্গে পণ্যের মানও নেমে যাচ্ছে, অনেক পণ্য নষ্ট হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় উৎপাদন একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে।’
পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগের একটি সূত্র বলছে, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৪০০ কোটি ঘনফুট। যার বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ২৬৬ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট। তবে বন্ধ থাকা দুটি এলএনজি টার্মিনাল চালু থাকলে গড় সরবরাহ থাকে ২৯০ কোটি ঘনফুটের কিছু বেশি। চাহিদা ও সরবরাহের বড় এ ব্যবধান অচিরেই নিরসনের কোনো লক্ষণ নেই।
দেশে স্থানীয় উৎপাদন ও এলএনজি আমদানি মিলিয়ে দৈনিক ২৮০-২৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে পেট্রোবাংলার। এর মধ্যে স্থানীয় গ্যাস ক্ষেত্রগুলো দৈনিক ২১০-২২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করে। বাকি গ্যাস আসে দুটি এলএনজি টার্মিনাল দিয়ে। তবে ২০২৬ সাল নাগাদ দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি চুক্তি বৃদ্ধি এবং এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ শেষে গ্যাস সরবরাহ বাড়ার ইঙ্গিত রয়েছে সরকারের। তার আগে দৈনিক ৩০০ কোটি ঘনফুটের চেয়ে বাড়তি সরবরাহ সম্ভব নয়।
সিরামিক শিল্প মালিকরা বলছেন, গত ১০ বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে বহু গুণ। ফলে এ খাতে ব্যয়ও বেড়েছে। এতে করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাম কমিয়ে বাজার ধরার জন্য উৎপাদন ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু বর্তমানে যে গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে, তাতে শিল্পটি টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাই সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে অচিরেই এটি একটি রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হবে। বেকার হয়ে পড়বে খাতসংশ্লিষ্ট অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ।