ইস্পাতশিল্পের কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে ডলারপ্রতি ৮৫ টাকার পরিবর্তে বর্তমানে ১২৫ টাকা দিতে হয়। এতে কোম্পানিগুলোর ঋণপত্রের সীমা দেশি মুদ্রায় ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। তার সঙ্গে গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি দাম, সুদের হার, ঋণপত্রের কমিশন, ঋণপত্রের মার্জিন, কাস্টমস ডিউটি, মূসক, কর ও অন্যান্য মাশুল বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যবসার চলতি মূলধনঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এমন তথ্য উল্লেখ করে ইস্পাত খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) নেতারা সরকারের কাছে এ খাতের সুরক্ষা চেয়েছেন। তাঁরা বলেন, ইস্পাত খাতকে রক্ষা করতে হলে অবিলম্বে সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে অনেক শিল্পকারখানা রুগ্ণ হয়ে যাবে। তাতে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক কর্মহীন হবেন। শ্রম অসন্তোষের ঘটনা বাড়বে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তাঁরা।
কোনো কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখতে আগে ১০০ কোটি টাকার চলতি মূলধন লাগলে এখন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে ১৬৫ কোটি টাকা লাগছে।
মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সভাপতি, বিএসএমএ
সুরক্ষা হিসেবে ইস্পাত খাতের স্বল্পমেয়াদি ঋণকে ১২ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তর করার দাবি জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে কোম্পানির ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে ঋণপত্রের সুবিধা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি বিদ্যুতের নতুন দাম ফেব্রুয়ারির পরিবর্তে মার্চ থেকে কার্যকর, উৎসে কর কর্তন ২ শতাংশের পরিবর্তে দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণ এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিএম সনদের মাশুল কোম্পানির বার্ষিক লেনদেনের ভিত্তিতে নির্ধারণ না করে নির্দিষ্ট করার দাবি করেছেন তাঁরা।
রাজধানীর পুরানা পল্টনে গতকাল মঙ্গলবার ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) মিলনায়তনে আয়োজিত ‘ডলার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে ইস্পাতশিল্পের চরম সংকট’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বিএসএমএর নেতারা। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বিএসএমএর সভাপতি ও জিপিএইচ ইস্পাতের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএসএমএর সাবেক সভাপতি মানোয়ার হোসেন ও শেখ মাসাদুল আলম, বর্তমান কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মুহাম্মদ শহিদউল্লাহ, সহসভাপতি মারুফ মহসিন, মো. আবদুস সালাম, মহাসচিব সুমন চৌধুরী প্রমুখ।
বিএসএমএ জানায়, দেশে ইস্পাত কারখানার সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। তার মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪০টি। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর বছরে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন ইস্পাত উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। যদিও দেশে বার্ষিক ইস্পাতের ব্যবহার ৭৫ লাখ টন। এখন পর্যন্ত এই খাতে ৭৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। বছরে লেনদেন হয় ৭০ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে ৫০ লাখ মানুষ জড়িত।
চলতি মূলধনঘাটতির বিষয়ে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কোনো কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখতে আগে ১০০ কোটি টাকার চলতি মূলধন লাগলে এখন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ অন্যান্য কারণে ১৬৫ কোটি টাকা লাগছে। শুধু ডলারের কারণে আমাদের চলতি মূলধনে ৪০ শতাংশ ঘাটতি হয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে আমরা কোনো প্রণোদনা বা মূলধন চাচ্ছি না। আমাদের স্বল্পমেয়াদি ঋণকে ১২ বছর পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি ঋণে রূপান্তর করা হোক।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঋণপত্রের অর্থ বিলম্বে পরিশোধের সময় ডলারের অতিরিক্ত বিনিময় মূল্যের কারণে কোম্পানিগুলো যে লোকসান করেছে, তা এক-দুই দিনে কভার করা যাবে না। ফলে সুবিধা না দিলে এই ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে। তখন সামগ্রিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়বে।
বিএসএমএ সভাপতি বলেন, ডলার-সংকটের কারণে ইস্পাতের কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাংকগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে পারছে না। ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হওয়ায় ইস্পাতের কাঁচামাল কম আসছে। ফলে কারখানাগুলোর পক্ষে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। পূর্ণ উৎপাদনক্ষমতা ব্যবহার করতে না পারায় ওভারহেড বা মাথাপিছু খরচ অনেক বেড়েছে। বর্তমানে এক টন রড উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৮৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। বাজারে উৎপাদন খরচের চেয়েও কম দামে রড বিক্রি হচ্ছে।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, গত বছর তিন দফায় বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি আবার দাম বাড়ানো হয়েছে, যা কিনা ওই মাসের শুরু থেকে কার্যকর করতে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। অথচ মূল্যবৃদ্ধির আগের বিদ্যুতের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হয়েছে। এখন অতিরিক্ত মূল্য প্রদান করতে হলে উৎপাদনকারীদের আর্থিকভাবে লোকসান গুনতে হবে। বিদ্যুতের মূল্য ভূতাপেক্ষভাবে কার্যকর করা মৌলিক আইনেরও পরিপন্থী।
বিএসএমএর সাবেক সভাপতি মানোয়ার হোসেন বলেন, যখন ডলারের দাম ৮৫ টাকা ছিল, তখন রডের দাম ছিল টনপ্রতি ৯২ হাজার থেকে ৯৩ হাজার টাকা। এখন ডলারের দাম বেড়ে ১২০-১২৭ টাকা হলেও রড ৯৫ হাজার থেকে ৯৭ হাজার টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমায় রডের চাহিদাও কমে গেছে। সে জন্য উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে রড বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা ন্যায্য মূল্যে পাচ্ছি না। তিনি আরও বলেন, শুধু ইস্পাত নয়, দেশে সব শিল্প খাতই সমস্যায় জর্জরিত। উত্তরণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।